মন্ত্রীর হুঙ্কার খোরাই কেয়ার-ঈদ যাত্রায় দ্বিগুন ভাড়া আদায় হচ্ছে
এস রহমান : এবারের ঈদে অতিরিক্ত বাস ভাড়া নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দেয়া এমন হুঙ্কারের পরও পরিবহন মালিকরা তাদের ইচ্ছে মতোই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।ঢাকা-নোয়াখালী রুটে চলাচলকারী হিমাচল ও মুনলাইন পরিবহন যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।স্বয়ং মন্ত্রীর এলাকায় চলাচলকারী বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করায় এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে সমালোচনা।
মাজহার মুনতাসির নামে নোয়াখালীর এক বাসিন্দা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব আপনি বলেছিলেন, ঈদের সময় অতিরিক্ত ভাড়া নিলে ব্যবস্থা নেবেন। অথচ আপনার জেলার (নোয়াখালী) বাস মালিকদের দিনে দুপুরে ডাকাতি চিত্র।
যেখানে নির্ধারিত ভাড়া থাকার কথা ২৮০ টাকা সেখানে নিয়মিত যাত্রীদের জিম্মি করে তারা নিচ্ছিল ৩৫০ টাকা করে। আর ঈদ উপলক্ষে ডাকাতিটা যেন আরো বেড়েই গেছে। ভাড়া ৩৫০ টাকার জায়গায় দাঁড়িয়েছে ৬০০ টাকা! বাসের ভাড়া কমানোর জন্য তেলের দামও কমানো হলো। এতে লাভটা হলো কোথায়? যেই কদু সেই লাউ।
শুধু নোয়াখালী নয় সকল জেলার ক্ষেত্রেই এমন গলাকাটা ভাড়া নিচ্ছে বাস ডাকাতরা। প্রমাণসহ দিলাম, এবার আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। আশা করি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়া মানে এ লজ্জা আমাদের নোয়াখালীর। কারণ আপনি আমাদের নোয়াখালীর মন্ত্রী।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সেতুমন্ত্রীর এপিএস মহিজুল হক বলেন, বিষয়টি আমি মন্ত্রী এবং সচিব মহোদয়কে জানাবো। আশা করি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।এদিকে, ঈদযাত্রায় ভোগান্তি ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নৈরাজ্য বন্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে “ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ নাগরিক ভাবনা” শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ দাবি জানান।
সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেলক হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক যোগাযোগ সচিব ড.মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, টিকিট ব্যবস্থাপনাসহ নানা ক্ষেত্রে ঈদ ব্যবস্থাপনায় গলদ রয়েছে।
এ কারণে পদে পদে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া ভাড়া নৈরাজ্যের প্রতিরোধে বিআরটিএ ও বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে প্রতিবছর ঈদে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ভিজিল্যান্স টিম বা মনিটরিং কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে কোথাও তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। দুর্ভোগের শিকার যাত্রীরা রাস্তায় আহাজারি করলেও কারও সহযোগিতা মেলে না।
ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় দেশের দশটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ১হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনও তাদের অস্তিত্ব মেলেনি কোথাও।
সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেলক হক চৌধুরী বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া সত্তেও প্রতিবছর ঈদ আনন্দ যাত্রায় ভোগান্তি, হয়রানি, ভাড়া নৈরাজ্যসহ নানাভাবে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সম্প্রতি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে চলাচলরত যাত্রীদের চাহিদার বিপরীতে স্বাভাবিক সময়ে গণপরিবহনে ৩৭.৪৪ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবার বা জোড়া সরকারি ছুটির আগের দিন এই ঘাটতির পরিমাণ ৫১.৩২ শতাংশে পৌঁছায়।
এছাড়া প্রতি ঈদে ২২ রমজান থেকে ২৭ রমজান পর্যন্ত এই গণপরিবহনে ঘাটতির পরিমাণ ৮৭.৮৯ শতাংশ হলেও ২৭ রমজান থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত বিদ্যমান গণপরিবহনের ১০ গুণ বেশি যাত্রী যাতায়াত করে থাকে। এ সময় যাত্রীদের চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের সংকট দাঁড়ায় ৩৭৪.৪৪ শতাংশ পর্যন্ত। এই সঙ্কটকে পুঁজি করে ঘটিয়ে থাকে নানা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও হয়রানি।
এবারের ঈদে লম্বা ছুটি কাজে লাগাতে ঢাকা থেকে ৯২ লাখ , চট্টগ্রাম মহানগর থেকে ৩১, সিলেট থেকে ৮, খুলনা থেকে ১২, রাজশাহী থেকে ৯ ও বরিশাল থেকে ৩ লাখা মানুষ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে বলে তাদের ধারণা।
এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ যাত্রী ওমরা পালনসহ বিদেশে ঈদ ভ্রমণ করবে। এছাড়াও এক জেলা থেকে অপর জেলায় যাতায়াত করবে আরও ৪ কোটি ৬০ লাখ যাত্রী। দেশের প্রায় প্রতিটি মহাসড়কে চলমান উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ, বিভিন্ন মহাসড়কে রাস্তার মাঝে সৃষ্ট গর্ত, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলমান ফ্লাইওভার নির্মাণ, বিভিন্ন রোডের বিভিন্ন স্পটে রাস্তার উপর বসা হাটবাজার ও ফুটপথ দখল এবারের ঈদযাত্রায় ভোগান্তি আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিবে।এছাড়া নৌপথে ওভারলোড কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা না হলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে আমরা অনেক পথ এগিয়ে গেলেও ঈদের টিকেট কাটতে কমলাপুর স্টেশনে বা গাবতলীতে এখন রাত পার করতে হয়। রিটার্ন টিকেটের জন্য ঈদের আনন্দ মিস করে কাউন্টারে কাউন্টারে ঘুরতে হয়। তিনি টিকেট ব্যবস্থাপনা ও গণপরিবহন আধুনিকায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি রুস্তম আলী খান ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে বেপরোয়া গতিতে যানবাহান চালানো বন্ধের আহ্বান জানান। ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে এবার মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি করা হবে বলেও জানান তিনি ।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ডিটিসিএ’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ঈদ ব্যবস্থাপনায় নাগরিক সমাজ, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও যাত্রী প্রতিনিধিদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে যাত্রী দুর্ভোগ লাঘব হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যাত্রী সাধারণের ভয়েসকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। তাই ঈদ কেন্দ্রিক প্রতিবছর সৃষ্ট দুর্ভোগের একই চিত্র হলেও এর থেকে উত্তোরণের রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না।
সংগঠনের পক্ষ থেকে এক প্রবন্ধে বলা হয়, গতবছর ঈদে এক সপ্তাহে ১৫৭ জন যাত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এবং ১ হাজার ১৭১ জন আহত হয়েছিল। এবারও সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। তাই দুর্ঘটনা প্রতিরোধের চিহ্নিত কারণসমূহ প্রতিকারে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
প্রতি বছর ঈদে ২৭ রমজান থেকে প্রতিটি সড়কে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় করা হয়। ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ঈদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আলোচনা সভা হলেও এখানে যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাউকেই ডাকা হয় না।