মদ নারীর বেলেল্লাপনায় উদ্মাম হোটেল রিজেন্সি শীশা বার
এস রহমান : মদ নারীর বেলেল্লাপনায় উদ্মাম হোটেল রিজেন্সি। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত এই হোটেলটি এখন অপরাধিদের আখড়া।শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানে এই হোটেল থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমান বিদেশী মদ বিয়ার।
একই ঘটনায় জব্দ করা হয়েছে, বিদেশী মদ বিয়ার পাচারে ব্যবহৃত হোটেল রিজেন্সির পরিচালক মোতাহারের একটি দামি গাড়ি।এই গাড়ি দিয়েই অবৈধভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী,সংসদ সদস্য অথবা গোয়েন্দা সংস্থার স্টিকার লাগিয়ে মদ বিয়ার পাচার করা হতো।
এসব সম্পর্কে রিজেন্সি হোটেলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কবির রেজা একটি পত্রিকাকে বলেছেন, তিনি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সরকার তাকে সিআইপি হিসেবে মনোনীত করেছে। তিনি দাবি করেন তার হোটেলে কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ নেই। তারা অযথা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, অবৈধ বিদেশী মদ-বিয়ারের আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর ‘হোটেল রিজেন্সি’। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যেমন অনেক সময় সাপ বেরিয়ে আসে, ঠিক তেমনি শুল্ক ফাঁকি দেয়া একটি গাড়ির সন্ধান করতে গিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা চাঞ্চল্যকর নানা তথ্যের সন্ধান পান।
একই সঙ্গে তারা জানতে পারেন, রীতিমতো বিপুল পরিমাণ আমদানি নিষিদ্ধ মদ-বিয়ারের খনিতে পরিণত হয়েছে এই হোটেলটি। আর এসব মদ-বিয়ার আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয় আইনশৃংখলা বাহিনীর স্টিকারযুক্ত গাড়ি। এমনকি সংসদ সদস্যের গাড়িও। এছাড়া হোটেলটিতে মদের আড্ডায় নাচ-গানের নামে যা হয় তা যেন সাক্ষাৎ এটা ইউরোপীয় কোন দেশের হোটেল। অর্থাৎ মদ নারীর বেল্লোপনা ও অশ্লীলতার একাকার অবস্থা।
শুল্কবিহীন একটি দামি রেঞ্জ রোভার গাড়ি জব্দ করার অভিযান থেকে বৃহস্পতিবার এই হোটেলের অন্দরমহলের নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। ফাঁস হয়ে যায় মাদক ব্যবসার বিস্ময়কর সব গোমর। এ কারণে গত দু’দিন থেকে খিলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত এ হোটেলটি এখন সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, বার লাইসেন্সের আড়ালে তারা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে চোরাই পথে আনা বিদেশী মদ-বিয়ারের রমরমা ব্যবসা করে আসছিল। এছাড়া হোটেলের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা একটি রেঞ্জ রোভার গাড়ির সন্ধানে তারা সেখানে অভিযান চালান। এ সময় তারা দেখতে পান অবৈধ মদ-বিয়ার পাচারের কাজে সংসদ সদস্য স্টিকারযুক্ত একটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করা হয়। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে আনা এসব অবৈধ বিদেশী মদ-বিয়ার অতি উচ্চমূল্যে হোটেলের বারে বিক্রি করা হচ্ছিল।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে আনা প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা দামের রেঞ্জ রোভার গাড়িটি ব্যবহার করতেন হোটেলের অন্যতম মালিক আরিফ মোতাহার। এই গাড়ি আমদানিতে অন্তত আড়াই কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়। গাড়িটি রেজিস্ট্রেশনও ছিল ভুয়া। শোরুম নম্বরপ্লেট লাগিয়ে গাড়িটি চালানো হচ্ছিল। এছাড়া আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে গাড়িতে সংসদ সদস্য স্টিকার ছাড়াও পুলিশ, ডিবিসহ বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনীর নামযুক্ত স্টিকার ব্যবহার করা হতো।
সূত্র জানায়, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের অভিযান চলাকালে মদ-বিয়ার পাচারের কাজে ব্যবহৃত রেঞ্জ রোভার গাড়িটি হোটেলের পার্কিং থেকে কৌশলে সরিয়ে ফেলা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত গাড়িটি তারা লুকিয়ে রাখতে পারেনি। শনিবার দুপুরে রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় চাবিসহ গাড়িটি ফেলে যায় রিজেন্সি হোটেলের লোকজন।
শনিবার পরিত্যক্ত অবস্থায় সেটি উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দারা। এরপর মাদক ব্যবসা ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে রিজেন্সির পরিচালক আরিফ মোতাহারকে গ্রেফতারে অভিযান শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। তবে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শুক্রবার রাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন আরিফ মোতাহার। ইমিগ্রেশন পুলিশ মোতাহারের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, অভিযান চালানোর সময় হোটেলের নিরাপত্তারক্ষীরা শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বাধা দেন। প্রায় ত্রিশ মিনিট বাকবিতণ্ডার পর অভিযানকারী কর্মকর্তারা হোটেলে ঢুকতে সক্ষম হন। এ সময় হোটেলের কর্মকর্তারা শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করেন।
কয়েকজন কর্মকর্তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে অভিযানকারী কর্মকর্তাদের ভয় দেখানোরও চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে ভীত না হয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা অভিযান অব্যাহত রাখেন। অবশ্য অভিযান বন্ধ করার জন্য গভীর রাতে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে সমাজের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ফোন আসে। তবে তা আমলে না নিয়ে অভিযান থেকে পিছু হটেননি তারা।
সূত্র জানায়, হোটেলের ১৩ তলায় অবস্থিত মদের বারে প্রতি রাতেই নগ্ন নৃত্যের আসর বসানো হয়। ‘মুজরা ড্যান্স’ নামে খ্যাত এ অশ্লীল ড্যান্সের আসরে হোটেলের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা স্বয়ং উপস্থিত থাকেন। তাদের জন্য সেখানে বিশেষ চেয়ার-টেবিলও বরাদ্দ থাকে। সেখানে বসে তারা মদ পান করেন। শুধু তাই নয় তাদের মদ পান ও আনন্দ-ফূর্তির বিল চাপিয়ে দেয়া হয় বারে আসা অন্য গেস্টদের ওপর।
গত মাসে কাশেম নামের জনৈক ব্যক্তি হোটেলের বারে মাত্র ৪টি বিয়ার পান করেন। কিন্তু তাকে ২২ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেয়া হয়। কাশেম নামের ওই ব্যক্তি অস্বাভাবিক এ বিল দিতে অস্বীকার করলে হোটেলের অস্ত্রধারী নিরপত্তারক্ষীদের দিয়ে তাকে নাজেহাল করা হয়। মানসম্মানের ভয়ে তিনি বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। অতিরিক্ত বিল দিয়ে সব হজম করেন। গত মাসেই বাচ্চু নামের আরেক ব্যক্তি হোটেলে মদ পান করতে গিয়ে একই ধরনের হয়রানির শিকার হন।
সূত্র জানায়, বার এলাকার (যেখানে মদ পান করা হয়) মধ্যে যৌন উত্তেজনাকর নাচ-গান আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ হলেও হোটেল কর্তৃপক্ষ বটলারদের (ড্যান্স পার্টির আয়োজক) কাছে ২০-২৫ লাখ টাকায় হল ভাড়া দেন। বর্তমানে হোটেলে অশ্লীল নৃত্য ও মদের আসর চালাচ্ছেন শাহিন ওরফে ডিসকো শাহিন ও নাইম ওরফে কাইল্ল্যা নাইম নামের দুই যুবক।
আগে এখানে লাইভ সং নামে অশ্লীল নাচের ব্যবসা করতেন রুস্তম ও রিজভী নামের আরও দুই বটলার। সূত্র বলছে, এখানে প্রতি বোতল বিদেশী মদ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। এছাড়া আমদানি নিষিদ্ধ প্রতি ক্যান বিদেশী বিয়ার বিক্রি করা হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকায়।
জানা গেছে, হোটেলের এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের পেছনে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কয়েকজন অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। এ হোটেল থেকে খিলক্ষেত থানা পুলিশ মোটা অংকের মাসোয়ারাও নিয়ে থাকে। হোটেলের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, খিলক্ষেত থানার ওসির প্রতিরাতের পেমেন্ট (ঘুষ) ৪০ হাজার টাকা। বাড়তি পাওনা হিসেবে হোটেলে মনোরঞ্জনের জন্য ওসি সাহেব বিভিন্ন গেস্ট পাঠান।
এসব গেস্ট নারী বান্ধবী নিয়ে হোটেলে অবস্থান করেন। এমনকি দেদার মদ পান করে মাতাল অবস্থায় তারা সেখানে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এ থানার সাবেক ওসি নজরুল ইসলাম (বর্তমানে শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত) খিলক্ষেত থানায় মাত্র আড়াই বছর দায়িত্ব পালনের সুবাদে ২ কোটি টাকায় উত্তরায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনেন। রিজেন্সি হোটেলে অবৈধ মদ বিয়ার ব্যবসায় সহায়তা করে তিনি মোটা অংকের ঘুষ পেতেন। ওই টাকা দিয়েই তিনি ফ্ল্যাট কিনতে সক্ষম হন।
তাছাড়া হোটেলের ৬ তলায় শিশা ওয়ার্ল্ড নামের একটি লাউঞ্জ রয়েছে। সেখানে নিরাপদে শিশা (এক ধরনের নেশা) পান করার জন্য ভিড় করেন উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া তরুণ-তরুণীরা। এই শিশা ওয়ার্ল্ড হোটেলে অবৈধ বিদেশী মদ বিয়ার ও অশ্লীল নৃত্য চালাতে পুলিশ ছাড়া আরও অনেক সহায়তাকারী রয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের খিলগাঁও সার্কেলের পরিদর্শক কামরুজ্জামান। তার জন্য হোটেল থেকে বাধা ঘুষের রেট প্রতিরাতে ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া হোটেল থেকে তিনি ২ লাখ টাকা মাসোয়ারা নেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রিজেন্সি হোটেলের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফা আফরোজ বলেন, পুলিশ এখন হোটেলের বিরুদ্ধে নানা কথা বলছে। কিন্তু থানার ওসি তো আমাদের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অংকের ঘুষ নেন। পুলিশের অনেক কর্মকর্তাও আমাদের হোটেলে রাতে ফ্রি থাকতে আসেন। তারা এখন সেসব কথা কেন স্বীকার করেন না। তিনি দাবি করেন, হোটেলের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চলছে। রিজেন্সি হোটেলে বেআইনি কিছুই হয় না।
মাসোয়ারা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে খিলক্ষেত থানার ওসি শহীদুল হক বলেন, তিনি এখানে নতুন যোগদান করেছেন। আগের কোনো ওসি মাসোয়ারা নিয়ে থাকলে সেটি তার জানা নেই। একইভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের খিলগাঁও সার্কেলের পরিদর্শক কামরুজ্জামান। তিনি দাবি করেন, নিয়মিত হোটেলের বার পরিদর্শন করেন। নিয়মিত বার পরিদর্শন করলে এত বিপুল পরিমাণ বিদেশী মদ-বিয়ার উদ্ধার হল কিভাবে- এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আমীর হোসেন বলেন, কোনো কর্মকর্তা যদি সঠিকভাবে বার পরিদর্শন না করেন বা বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসব সম্পর্কে হোটেলের নির্বাহী পরিচালক শহীদ হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অফিসে নেই বলে জানানো হয়।অন্যদিকে হোটেলের জনসংযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মি. ফয়সাল জাতিরকন্ঠকে জানান, সীসা বারের লাইসেন্স ছাড়াই তারা এটা চালাচ্ছেন।তার দাবি এটা কোন অবৈধ না।এছাড়া হোটেলে অশ্লিলতা বেলেল্লোপনা নাচ এখন হচ্ছে না বলেও তিনি জানান।