মগজ ধোলাইয়ের শিকার কি জঙ্গিরা? ছয় জঙ্গির অজানা অধ্যায়
বিশেষ প্রতিনিধি : মগজ ধোলাইয়ের শিকার কি জঙ্গিরা? তানাহলে এই জঙ্গিরা ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়োশোনা করার পরও কেন জঙ্গি দলে যাবেন? গুলশানের আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে হামলা চালানো জঙ্গিদের মধ্যে চারজনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
তারা সবাই বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর সন্তান। পড়াশোনা করতেন দেশ-বিদেশের নামিদামি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষা গ্রহণের পুরো পর্যায়ই পড়াশোনা করেছেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। কোনো দিনই কেউ মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেননি। সবাই থাকতেন অভিজাত এলাকায়। ভালো পরিবার থেকে উঠে আসা এসব তরুণ হঠাৎ উধাও হয়ে যান বাড়ি থেকে। এ জন্য থানায় জিডিও করা হয়েছিল। তাদের খোঁজে ফেসবুক ও গণমাধ্যমে আকুল আবেদনও করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু তাদের সন্তানরা ফিরে আসেননি। আন্তর্জাতিক জঙ্গি চক্রে পড়ে তারা গুলশানে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে হতবাক ও স্তম্ভিত করে দিয়েছেন বিশ্ব বিবেককে। জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে হামলায় ছয় জঙ্গির নিহত হওয়ার ছবি প্রকাশ করা হয়
। এর কিছু সময় আগে আইএসের পক্ষ থেকে পাঁচ হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। দুটি ছবি প্রকাশের পরই শুরু হয় ছবি বিশ্লেষণ। ছবির ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত স্বজন, সহপাঠীরা পরিচয় শনাক্ত করা শুরু করেন। নিহত হামলাকারীদের ছবি ও আইএসের দেওয়া ছবি উভয়টাতেই আছে চারজন। তারা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। আইএস যে পাঁচজনের ছবি প্রকাশ করেছে, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মহানগর শাখার এক নেতার ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সে নেই নিহত হওয়া ব্যক্তিদের ছবির মধ্যে। সেও উচ্চবিত্তদের পক্ষে খরচ মেটানো সম্ভব বাংলাদেশের এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছিলেন। তবে নিহত ছয় ব্যক্তির মধ্যে ছয় নম্বর ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ছয় নম্বর ব্যক্তি রেস্টুরেন্টটির বাবুর্চি। কারণ জিম্মি ও হামলার সময় রেস্টুরেন্টের বাইরে এক বাবুর্চির জন্য আর্তনাদ করা এক নারী তার ছেলের যে ছবি দেখিয়েছিলেন, ছয় নম্বর ব্যক্তির সঙ্গে সেই ব্যক্তি মিলে যাচ্ছে। আইএসের পক্ষ থেকে পাঁচ হামলাকারীর নাম বলা হয়েছে—আবু উমর, আবু সালমা, আবু রহিম, আবু মুসলিম ও আবু মুহারিব। অন্যদিকে পুলিশ বলেছে পাঁচ জঙ্গির নাম—আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন ও রিপন। কিন্তু হামলাকারীদের আসল নাম ভিন্ন। তাদের নাম—নিব্রাস ইসলাম, আন্দালিব আহমেদ, রাইয়ান মিনহাজ, মীর সামি মোবাশ্বির।
নিব্রাস ইসলাম : হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া জঙ্গিদের অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন নিব্রাস ইসলাম। তার বাবা একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ঢাকার ওয়ারী ও উত্তরায় আছে তাদের নিজস্ব বাড়ি। নিব্রাসের তিন চাচার মধ্যে একজন সরকারের উপসচিব, একজন পুলিশ কর্মকর্তা, আরেকজন বিজ্ঞানী। নিব্রাস ইসলাম পড়াশোনা করেছেন ঢাকার উচ্চবিত্তদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে। সেখান থেকে ও-লেভেল এবং এ-লেভেল শেষ করার পর পড়াশোনা করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও খরচের নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পরে ২০১৪ সালের জুলাইয়ে পড়তে চলে যান অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে। নিব্রাসের আগ্রহ ছিল ফুটবলে। খেলতেনও বেশ ভালো। নিব্রাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন। তার একটি ভিডিও আপলোড করা হয়েছে ফেসবুকে, যাতে দেখা যায়, তিনি বন্ধুদের সঙ্গে একটি প্রাইভেটকারে বসে ইংরেজিতে খোশগল্প করছেন। ১০-১২ জন বন্ধুর সঙ্গে সেলফির ছবিও রয়েছে ফেসবুকে। বোন ও আত্মীয়স্বজনসহ, আবার কখনো নিজের একার পোজ দেওয়া ছবিতেও তাকে দেখা যায়। নিব্রাস কবে থেকে জঙ্গির সঙ্গে সম্পৃক্ত তা এখনো স্পষ্ট হয়নি।
মীর সামি মোবাশ্বির : বর্বর এ হামলায় অংশগ্রহণকারী মীর সামি মোবাশ্বির স্কলাসটিকার এ-লেভেলের ছাত্র। মোবাশ্বিরের বয়স ১৭ বছর। মোবাশ্বিরের বাবা অ্যালকাটেল-লুসেন্ট বাংলাদেশের কর্মকর্তা। মা সরকারি কলেজের শিক্ষক। বড় ভাই পড়ছেন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২৯ ফেব্রুয়ারি গুলশান-২ আগোরা ডিপার্টমেন্টাল শপের সামনে থেকে নিখোঁজ হন মীর সামি মোবাশ্বির। তিনি সেখানকার একটি বাড়িতে প্রাইভেট পড়তে যেতেন। নির্দিষ্ট সময়ে না ফেরার কারণে ড্রাইভার তার নম্বরে কল দেন।
কিন্তু ফোনের সুইচ অফ। বিষয়টি ড্রাইভার তাত্ক্ষণিকভাবে মোবাশ্বিরের বাবা ও মাকে জানান। ড্রাইভার ফিরে যান বাসায়। মোবাশ্বিরের খোঁজ না পেয়ে গুলশান থানায় জিডি করা হয়। তার নিখোঁজের খবর ২ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে জিডির বিষয়ে গুলশান থানার সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। থানা পুলিশ বলেছিল, তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।
২৭ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে মোবাশ্বির আইএসে যোগ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে তার ছবি তখন প্রকাশিত হয়। সন্তানকে ফিরে পেতে তার মাও আকুতি জানিয়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই মোবাশ্বির গুলশানের নৃশংস হামলায় অংশগ্রহণ করেন।
রোহান ইমতিয়াজ : আইএসের তালিকায় থাকা আরেক জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ স্কলাসটিকা স্কুলের সাবেক ছাত্র। বাবা-মার সঙ্গে তার ছবির পাশে দেওয়া হয়েছে সাইটের ছবি, যেখানে দুই ছবির মধ্যে মিল পাওয়া যায়। রোহানের বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক এবং বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল। রোহান ইমতিয়াজের মা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণিতের শিক্ষক। বাবা ও মার সঙ্গে তার ছবির পাশে সাইটের ছবি বসিয়ে ফেসবুকে অনেকেই দুই ছবির চেহারায় মিল দেখাচ্ছেন।
বাবুল ৪ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর থানায় যে জিডি করেছেন, তাতে ছেলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজের বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ২০ বছর। চেহারার বিবরণে বলা হয়েছে, উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, গায়ের রং ফরসা, মুখমণ্ডল লম্বাটে, মাথায় ঘন কালো চুল। জিডিতে বলা হয়, গত বছর ২৫ ডিসেম্বর চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক ভারতে যান ইমতিয়াজ বাবুল।
ভারতে থাকার সময় ৩০ ডিসেম্বর রোহান বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি বলে খবর পান তিনি। এরপর বাবুল সন্তানকে ফিরে আসার জন্য ফেসবুকে আকুতি জানিয়েছিলেন—বাবা ফিরে এসো। এর সাত মাস পর শুক্রবার হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর আইএস হামলাকারী হিসেবে তাদের পাঁচ সদস্যের যে ছবি ইন্টারনেটে দেয়, তাতে রোহানের ছবি আসে।
রাইয়ান মিনহাজ : স্কুলজীবন কেটেছে খ্যাতনামা ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগা খান স্কুলে। সেখান থেকে ও-লেভেল পাসের পর পড়েছেন আরেক সুপ্রতিষ্ঠিত ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লে পেন-এ। এরপর মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান রাইয়ান। থাকতেন মালয়েশিয়ার পেতালিং জায়া নামক এলাকায়।
আন্দালিব আহমেদ : মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিরই আরেক ছাত্রকে শনাক্ত করা হয়েছে আন্দালিব আহমেদ হিসেবে। মোনাশে যাওয়ার আগে আন্দালিব পড়েছেন ঢাকার নামকরা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল সানিডেলে। তিনিও ঢাকার অভিজাত এলাকার একজন বাসিন্দা। বাবা ব্যবসায়ী।
গোয়েন্দা নজরদারিতে প্রকৌশলী হাসনাত রেজা করিম : গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তোরাঁয় চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক প্রকৌশলী হাসনাত রেজা করিমকে কড়া নজরদারির মধ্যে রেখেছে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের ধারণা, ওই হামলার ঘটনায় হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সমন্বয়কারী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
একটি ছবিতে দেখা গেছে জিম্মি হয়ে আটক থাকার সময় তিনি রেস্তোরাঁটির দোতলায় দুই হামলাকারী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে সিগারেট টানছিলেন। যদিও তার পরিবারের সদস্যদের দাবি হচ্ছে, বড় মেয়ে সাফার জন্মদিন পালন করার জন্যই প্রকৌশলী হাসনাত রেজা করিম ওইদিন সপরিবারে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন। পরদিন হাসনাতের পরিবারকে অক্ষত অবস্থায় মুক্তি দেয় জিম্মিকারীরা। জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছিলেন হাসনাতের স্ত্রী মাথায় হিজাব পরার কারণেই তাদের সপরিবারে মুক্তি দিয়েছে জিম্মিকারীরা।
জানা গেছে, দুই বছর আগে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গি তত্পরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছিল প্রকৌশলী হাসনাতের বিরুদ্ধে।