• বৃহস্পতিবার , ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

ভোক্তা ও কৃষক বাঁচাতে বাড়তি ভ্যাট ট্যাক্স সরান-বাপার আলটিমেটাম


প্রকাশিত: ৭:৪৬ পিএম, ১৬ জানুয়ারী ২৫ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫ বার

আজ যখন ৫ টাকার বিস্কুটে ভ্যাট বাড়ানো হবে কাল থেকে আমি দুইটা বিস্কুট কমিয়ে খাব। কারণ অন্যথায় আমি সরকারকে ভ্যাট দিতে পারব না। তাই আসেন আমরা আমাদের ভোক্তাকে বাঁচাই। আমাদের কৃষককে বাঁচাই। বাংলাদেশের যে অ্যাগ্রো প্রসেসিং সেক্টর আছে তা উত্তরোত্তর এগিয়ে যাবে।

 

 

বিশেষ প্রতিনিধি : ভোক্তা ও কৃষক বাঁচাতে বাড়তি ভ্যাট ট্যাক্স ৭ দিনের প্রত্যাহার না করলে রাস্তায় নামার হুশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। তাঁরা বলেছে, আগামী সাতদিনের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার না করলে রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় থাকবে না।কথাগুলো বলেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী। বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। তিনি সরকারকে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার এবং প্রস্তাবিত গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বাপার নেতারা আগামী সাতদিনের মধ্যে সরকারকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। যদি এ সময়ের মধ্যে আরোপিত ভ্যাট ও শুল্কের সঙ্গে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব থেকে সরকার সরে না আসে তবে স্বেচ্ছায় কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ এবং সচিবালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি।

বাপার সভাপতি এম এ হাশেমের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হকের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন এসিআই অ্যাগ্রো বিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারি, এসএমসি এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ নাসির, বাংলাদেশ বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া, আকিজ ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের পরিচালক সৈয়দ জহুরুল আলম, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের চিফ অপারেটিং অফিসার পারভেজ সাইফুল ইসলাম, কিশোয়ান ও বনফুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলামসহ কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতের বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা।

সংবাদ সম্মেলনে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আজ আমি এখানে মনের দুঃখ নিয়ে এসেছি। দুঃখ এজন্য আমরা এমন এক সেক্টরের কথা বলছি যেখানে সাধারণ মানুষ জড়িত। আপনি যখন টমেটো কেচাপের দাম বাড়াবেন, ভ্যাট বাড়াবেন তখন কৃষক এবং ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনি যখন আমার পণ্যের ভ্যাট বাড়াবেন, এর সাথে জড়িত যে মানুষগুলো আছে তার পকেট থেকেই আসবে। আমার যে কৃষক আছে, যারা উৎপাদন করে, তার পকেট থেকেই আসবে।‘বিস্কুট বাংলাদেশের আমজনতার খানা, এটা কোনো বড়লোকের খানা নয়। ৫-১০ টাকার বিস্কুট বড়লোকে খায় না। আমাদের উৎপাদিত ৭৫-৯০ শতাংশ বিস্কুটের দাম ৫-১০ টাকা। বিস্কুটের দাম ২০ টাকা হলে সেটা খাওয়ার মতো ক্রেতা বাংলাদেশে নেই।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আজ যখন ৫ টাকার বিস্কুটে ভ্যাট বাড়ানো হবে কাল থেকে আমি দুইটা বিস্কুট কমিয়ে খাব। কারণ অন্যথায় আমি সরকারকে ভ্যাট দিতে পারব না। তাই আসেন আমরা আমাদের ভোক্তাকে বাঁচাই। আমাদের কৃষককে বাঁচাই। বাংলাদেশের যে অ্যাগ্রো প্রসেসিং সেক্টর আছে তা উত্তরোত্তর এগিয়ে যাবে। আমরা মনে করি বাংলাদেশে এটা একটা উদীয়মান সেক্টর। আমাদের এখানে দু-চার লাখ মানুষ কাজ করছে। আগামীতে আরও অসংখ্য মানুষ এই খাতে কাজ করবে। দুই কোটির বেশি কৃষক আছে, যারা আমাদের সাথে কাজ করছে। আমরা চাই আগামী দিনে যেন খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প আরও গড়ে ওঠে, সকলে যেন সুলভমূল্যে খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করতে পারেন।’

‘আমরা মনে করি এটা আমজনতার ব্যবসা। আমরা ভালো ব্যবসায়ী হতে চাই। আমরা সরকারকে সঠিক মূসক (ভ্যাট) প্রদান করতে চাই। যুক্তিসঙ্গত মূসক প্রদান করতে চাই। আগামী দিনে মানুষ কিন্তু ৫ টাকা, ১০ টাকা দামের বিস্কুট ক্রয় করতে পারবেন না, রুটি ক্রয় করতে পারবেন না। আসুন এই যুদ্ধে আমরা সবাই শরিক হই। আমরা সরকারকে জানিয়ে দেই যে আমরা আমাদের খাদ্যসামগ্রীর ওপর কোনো রকমের ভ্যাট-ট্যাক্সের আক্রমণ বাংলাদেশ বিগত দিনে সহ্য করিনি, আগামীতেও সহ্য করবো না।’

আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ সরকারকে বলতে চাই, আপনারা ৯ শতাংশ, ১১ শতাংশ সুদের হার বাড়িয়ে ১৬ শতাংশ করেছেন। শুনেছি আপনারা মুদ্রাস্ফীতি কমাচ্ছেন। আপনাকে ধন্যবাদ যে আপনি ইনফ্লেশন কমানোর চেষ্টা করছেন। আমাদের ওপর ভ্যাটের বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে ইনফ্লেশন কমানোর চেষ্টা করছেন। দয়া করে খাবারের জিনিসের ওপর কোনো ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়াবেন না। তাহলে মানুষের মনের ক্ষোভ প্রকাশ হবে। আসুন আমরা একটা ভালো মানের ভ্যাট-ট্যাক্স যা আমরা বিগত দিনে দিয়ে এসেছি, আগামী দিনেও আমরা ভালো মানের ভ্যাট দেব; যেন আমরা ভালো থাকতে পারি। যেন আমরা ভোক্তার কাছে আরও ভালো মানের পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে পারি। বাংলাদেশে ফুড প্রসেসিং সেক্টর একটা উদীয়মান শিল্প। শিল্প কিছুই গড়ে ওঠেনি। আগামী দিনে শিল্প গড়ে ওঠার অনেক বাকি আছে।’

সরকারকে নিজেদের খরচ কমানোর অনুরোধ জানিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সিইও বলেন, ‘যদি ১০ শতাংশ খরচ কমানো যেত তাহলে ১২ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা বেঁচে যেত। আপনাদের খরচ কমানোর কোনো দৃষ্টান্ত তো দেখতে পাচ্ছি না। আসেন আমরা একটু খরচ কমাই। আমাদের সাথে কথা বলেন। আমরা ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনা করি, লাখ লাখ মানুষ খাটাই। যখন ভ্যাট বাড়ালেন তখন তো একবারও আলাপ করলেন না, হঠাৎ করে বাড়িয়ে দিলেন। কালকে থেকে কীভাবে ব্যাংক ঋণ শোধ করব।’

‘যখন ব্যবসায়ীরা দেউলিয়া হয় তখন বলা হয় যে ব্যবসায়ীরা নাকি টাকা সরিয়েছেন, টাকা হারিয়েছেন। হাজার রকমের অপবাদ ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়। তাহলে ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বাঁচে কীভাবে? আপনারা আমাদের ভ্যাট ৩০০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৫ শতাংশের ভ্যাট নিয়ে গেছেন ১৫ শতাংশে। দেওয়ালে মানুষের পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা রাস্তায় নামতে চাই না। আগামী দিনে যদি ব্যবসা না থাকে রাস্তায় নামা ছাড়া কিন্তু কোনো উপায় থাকবে না।’ যোগ করেন আহসান খান চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী সাতদিন আপনার সাথে কথা বলব, বার বার আসব, ভিক্ষা করব, বিনয় করব, যুক্তি দেব। তারপর কিন্তু রাস্তায় নামা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। কারণ যদি ব্যবসা না থাকে তাহলে আগামী মাসে দেড় লাখ মানুষের বেতন কোথা থেকে দেব? আমরা ভ্যাট খেলাপি হতে চাই না। আমাদের ঋণ খেলাপি বানাবেন না। আমরা চাই যেভাবে থাইল্যান্ডে অ্যাগ্রো প্রসেসিং শিল্প গড়ে উঠেছে, যেভাবে ভিয়েতনাম এগিয়ে গিয়েছে আমাদের ভ্যাট তাদের সাথে সমন্বয় করুন। সমন্বয় করার মাধ্যমে আগামী দিনে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।’

‘শত কষ্ট হলেও কিন্তু আমরা ৫ টাকার বিস্কুট ৫ টাকা রাখার চেষ্টা করব। ৫ টাকার বিস্কুট যখন ৭ টাকা চেয়ে নিতে হয় তখন খুব কষ্ট হয়। একটা বাচ্চা যখন কাল থেকে ৫ টাকা দিয়ে বিস্কুট কিনে একটা জুসে হাত বাড়াতে পারবে না তখন চোখ থেকে পানি বের হয়ে যাবে। আমরাও মানুষ। আমরা ব্যবসায়ী হতে পারি, তবে সর্বপ্রথমে আমরা বাঙালি। আমরা বাংলাদেশে ব্যবসায়ী হয়ে সেবার মানসিকতা নিয়ে ব্যবসা করতে চাই। আপনারা আমাদের সরকার, আপনারা আমাদের পাশে থাকুন।’
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবেন। যদি কথাগুলো পরিষ্কার না হয় তাহলে আপনার অফিসে ডাকবেন, দেখা করতে গেলে একটু সময় দেবেন। তারপরও যদি যুক্তিসঙ্গত না হয়, আমাদের ওপর যদি রোলারকোস্টার চালাতে বাধ্য হন, সেক্ষেত্রে আমরা রাজি আছি।’

‘আগে বাংলাদেশ থেকে কোনো ফুড প্রোডাক্ট বিদেশে রপ্তানি হতো না। বর্তমানে ১৩৭টি দেশে বাংলাদেশের খাদ্য রপ্তানি হয়। বাংলাদেশের কোনো পণ্য যখন বিদেশে যায় আমরা সবাই অনুপ্রাণিত হই, খুশি হই। আমাদের ভালো করার পূর্বশর্ত হচ্ছে আমাদের লোকাল মার্কেট। অনুগ্রহপূর্বক এই মার্কেট হওয়ার আগেই ধ্বংস করে দেবেন না। আসেন আমরা সবাই মিলে কাজ করি যাতে আমাদের কৃষকের উপকার হয়, কৃষক যেন আরও লাভজনকভাবে কৃষি উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকে। আমরা এবং কৃষকরা কিন্তু একই সুতোয় বাঁধা। অনুগ্রহপূর্বক এই শিল্পটা জন্মের আগেই মেরে ফেলবেন না।’

আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের যে খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনশিল্প আছে সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এজন্য প্রয়োজন বিনিয়োগের পরিবেশ, নিম্নমানের ভ্যাট, নিম্নমানের ট্যাক্স। আসেন আমরা এই শিল্প যেন ব্যবসায়ীদের উপহার দিতে পারি। আপনারা ট্যাক্সের বোঝা অযৌক্তিকভাবে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপাবেন না। রেস্টুরেন্ট শিল্পে আপনারা যেমন সুযোগ দিয়েছেন আশা করি আপনারা আমাদের শিল্পের দিকে তাকাবেন। অন্যায়ভাবে আমাদের ওপর কোনো ভ্যাট, শুল্ক, ট্যাক্স আরোপ করবেন না। যেভাবে চলছিল, অনেক কষ্টের মধ্যে চলছিল। আশা করি আগামীতে আরও ভালো চলবে, এজন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে ভালো ট্যাক্সের ব্যবহার, ভালো ট্যাক্সের মান নির্ধারণ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ যেন এগিয়ে যেতে পারে। আসুন আমরা গঠনমূলকভাবে ট্যাক্স কমাই যাতে ভোক্তা, কৃষক, ক্রেতা, ব্যবসায়ী অনুপ্রাণিত হতে পারে।’

‘বাণিজ্য উপদেষ্টার সাথে আমরা সংলাপ করেছি, আমি উনাকে বলেছি যে আমরা আপনার অফিসের সামনে বসে থাকবো যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আমাদের ভ্যাটের বিষয়টা সমাধান না করেন। আমি আপনাকে অনুরোধ জানাবো।’ বলছিলেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান।ব্যবসায়ীদের মতে, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ওপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপানো হলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষক ও নিম্নআয়ের মানুষ। যে হারে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য বিস্কুট, কেক, জুসসহ বিভিন্ন খাদপণ্য ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। ভোক্তারা ক্রয়ক্ষমতা হারালে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে এরই মধ্যে এ খাতে সরাসরি কাজ করা প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিকের কাজ হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে পুরো খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিতে বাজার হারানোর শঙ্কা রয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর যে উদ্দেশ্য, সেটি হীতে বিপরীত হতে পারে বলে মনে করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।