• সোমবার , ১৮ নভেম্বর ২০২৪

ভেগেছে ইউনিয়ন ব্যাংক এমডি-বনানীতে এমডির দুই দামি গাড়ি


প্রকাশিত: ৫:০৫ এএম, ১১ অক্টোবর ২৪ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩২ বার

 

এস রহমান : ভাগালপুরে ভেগে গেছেন ইউনিয়ন ব্যাংক এমডি। তবে কোথায় ভেগেছেন তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী নিজে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সোমবার দুপুরেই তাঁর স্ত্রী নাজনীন আকতার দুই ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে বাসা ছাড়েন। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আলোচিত এই ব্যাংকার নীরবে বাসা থেকে একা বের হয়ে যান। ব্যাংকের পরিচালকদের চোখে তিনি এখন নিখোঁজ। বনানীতে তাঁর বাসার নিচে পড়ে রয়েছে দুটি গাড়ি।

মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর মোকাম্মেল হক চৌধুরীকে আর দেখা যায়নি। বুধবার তিনি কাজেও যোগ দেননি। ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালকেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরকে বিষয়টি জানানোর পর বুধবার রাতেই উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শফিউদ্দিন আহমেদকে এমডির চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। মোকাম্মেল হক চৌধুরীর বাসভবন ও ইউনিয়ন ব্যাংকের খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বনানী থানা থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে একটি বহুতল ভবনে পরিবার নিয়ে থাকতেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী। নিজের কেনা ২ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট তাঁর। দুই ছেলে-মেয়েই স্কুলপড়ুয়া। মোকাম্মেল হক নিজে ব্যবহার করতেন টয়োটার প্রাডো মডেলের একটি গাড়ি। পরিবারের সদস্যদের জন্য ছিল একটি মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার গাড়ি। ভবনে কর্মরত নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে জানা গেল, তাঁর বাসায় বাইরের লোকজন তেমন একটা আসতেন না। তবে মাঝেধ্যে মোকাম্মেল হক চৌধুরীর শ্যালক ও শাশুড়ি আসতেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৭ আগস্ট বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে নতুন পর্ষদের সদস্যদের অভিযোগ, ব্যাংকটিতে এস আলমের প্রভাব এরপরও কমেনি। এমডি মোকাম্মেল হকের অসহযোগিতার কারণে তাঁরা ব্যাংকটির অবস্থার বিষয়ে সঠিক তথ্যও পাননি।

এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইউনিয়ন ব্যাংকের একটি রহস্যময় হিসাব থেকে নগদ টাকা উত্তোলন ও মোকাম্মেল হক চৌধুরীর নিজের হিসাব থেকে তাঁর গচ্ছিত পুরো অর্থ তুলে নেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, গত মঙ্গলবার সর্বশেষ বার ব্যাংকে গিয়েছিলেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী। তবে বেশি সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। বিকেলের দিকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য পরিচয় দেওয়া কিছু ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি ব্যাংক ছেড়ে চলে যান।

বৃহস্পতিবার বনানীতে তাঁর বাসায় খোঁজ নিলে কর্মচারীরা জানান, সোমবার দুপুরে তাঁর স্ত্রী দুই ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে বাসা ছাড়েন। মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার গাড়িটি তাঁদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়। বাসার গৃহকর্মীদের এর আগেই ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে গাড়িটি বাসার গ্যারেজে পড়ে রয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টয়োটা প্রাডো গাড়িতে বাসায় ফেরেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী। এরপর সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে গাড়ি ছাড়াই বাসা থেকে একা বের হয়ে যান। গাড়ির চালক বাসার নিচে অপেক্ষা করলেও তাঁকে কিছু জানাননি। এর পর থেকে দুই গাড়ির চালক মাঝেমধ্যে ওই ভবনের নিচে আসছেন, কিন্তু নিয়োগদাতার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছেন না।

ওই ভবনের ম্যানেজার মাসুম বিল্লাহ জানান, মোকাম্মেল হক চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী কাউকে কিছু জানিয়ে যাননি। সোমবার দুপুরে পরিবারের সদস্যরা ও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি বের হয়ে গেছেন। এরপর আর বাসায় ফেরেননি।গতকাল বুধবার সকালে ব্যাংকে না যাওয়ায় মোকাম্মেল হক চৌধুরীর খোঁজ নিতে কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাসায় পাঠান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মো. ফরিদউদ্দীন আহমদ। এরপর মোবাইল বন্ধ থাকায় ও তাঁকে বাসায় না পাওয়ায় এমডি ‘নিখোঁজ’ বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানান চেয়ারম্যান। সেদিনই গভর্নরের সঙ্গে ইউনিয়ন ব্যাংক পর্ষদের পূর্বনির্ধারিত সভা ছিল। সেখানেই জানানো হয়, সভায় যোগ দেওয়ার জন্য এমডিকে পাওয়া যায়নি। এরপর বুধবার রাতেই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভা ডেকে ডিএমডি শফিউদ্দিন আহমেদকে এমডির চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ইউনিয়ন ব্যাংকের এক কর্মকর্তা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, মোকাম্মেল হক পরিবারসহ বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন বলে তাঁরা শুনেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সহায়তা করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য। আরও কয়েকটি ব্যাংকের মতো ইউনিয়ন ব্যাংকের মালিকানা ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকটির মোট ঋণের মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশই নিয়েছে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে কাল্পনিক লেনদেনের মাধ্যমে, যার বিপরীতে জামানতও নেই। আবার ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে বলে ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়েছিল, খেলাপি ঋণের হার ৪ শতাংশের কম।

এস আলম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংক দখল করে লুট ও অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে বিশেষ সুবিধা পাওয়া অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। অভিযোগ রয়েছে, সাইফুল আলমের হয়ে তাঁর ছেলে আহসানুল আলম, জামাতা বেলাল আহমেদ, তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ও ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন ও ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অপরাধ করেছেন।

এর পাশাপাশি মোকাম্মেল হক চৌধুরী পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগর প্রধান হারুন অর রশীদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। এ কারণে ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত টাকার হিসাবে গরমিলসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি।ওদিকে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. ফরিদউদ্দীন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি। বুধবার সকাল থেকেই এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।