`ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন অধ্যায় দেখতে পাবে’
দীনা করিম : ঢাকা:
বিএনপির চেয়ারপারসন ভারতের নতুন সরকারকে অভিনন্দন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক টেকসই করতে মোদি সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সুষমা স্বরাজকে খালেদা জিয়া বলেন, ভারতের নির্বাচনের ফলাফলে মানুষের মনে আশা জেগেছে যে তারা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন অধ্যায় দেখতে পাবে। পারস্পরিক লাভ ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে এ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত বলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কাছে মন্তব্য করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া৷
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত পাশের দেশ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে চায় কি না, তা সুষমা স্বরাজের কাছে জানতে চেয়েছেন খালেদা জিয়া। প্রশ্নটির সরাসরি কোনো উত্তর দেননি সুষমা স্বরাজ। তবে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ভারত তার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দেবে।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় তাঁদের আলোচনায় এভাবেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রসঙ্গটি উঠে আসে৷
তিন দিনের সফর শেষে গতকাল দুপুরে নয়াদিল্লি ফিরে গেছেন সুষমা স্বরাজ৷
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায় জানান পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর প্রথম ঢাকা সফরকে ‘চমৎকার সূচনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সুষমা স্বরাজ ঢাকা ছাড়ার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় এ তথ্য জানান ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দীন।
খালেদা-সুষমা বৈঠক: গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে খালেদা জিয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈঠকে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। তথাকথিত সংসদ জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত করে না। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ তার প্রতিবেশী দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে চায় কি না, তা আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে।’
বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে মঈন খান আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রীর প্রধান কর্মসূচি সেটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেও বলা হয়েছে, প্রথম যে বিষয়টি আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক আঞ্চলিক ভিত্তিতে দেখতে চাই, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মঈন খান বলেন, ‘এই অঞ্চলে ভারত বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্র। প্রতিবেশী দেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত থাকলে তা এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত করবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ভারতের নতুন সরকার বাংলাদেশের বিশেষ কোনো দল নয়, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় বলে সুষমা স্বরাজ খালেদা জিয়াকে জানিয়েছেন।
শমসের মবিন বলেন, বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন ভারতের নতুন সরকারকে অভিনন্দন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক টেকসই করতে মোদি সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সুষমা স্বরাজকে খালেদা জিয়া বলেন, ভারতের নির্বাচনের ফলাফলে মানুষের মনে আশা জেগেছে যে তারা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন অধ্যায় দেখতে পাবে। পারস্পরিক লাভ ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে এ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
শমসের মবিন বলেন, খালেদা জিয়া দ্বিপক্ষীয় অমীমাংসিত বিষয়গুলো দ্রুত আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জবাবে সুষমা স্বরাজ এ বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কাজ চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির নেতা বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন বা সংলাপ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে সুষমার সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার আপত্তি করেছিল। এসব আপত্তি অতিক্রম করেও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারত যে কোনো দল নয়, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চায়, এই বৈঠক তারই প্রতিফলন।’
আধা ঘণ্টার বৈঠকের ১০ মিনিটের মতো খালেদা জিয়া ও সুষমা স্বরাজের মধ্যে একান্ত আলাপ হয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
কূটনীতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, গণতন্ত্র, অমীমাংসিত বিষয় ও নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে খালেদা জিয়া ও সুষমা স্বরাজের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে বাংলাদেশের অবদানের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানান সুষমা৷ তিনি দুই দেশের স্বার্থে এ সহযোগিতা আগামী িদনে অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দেন।
জানা গেছে, গণতন্ত্র প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এ দেশের মানুষেরই সমাধান করা উচিত বলে অভিমত দেন।
বৈঠকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কূটনীতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, গণতন্ত্র, বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতারা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সুস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেভাবে কোনো ইঙ্গিত সুষমা দেননি। বরং স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশে যেকোনো দলের সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করবে ভারত৷ এতে করে বৈঠকের পর বিএনপির নেতাদের কিছুটা হতোদ্যম মনে হয়েছে।
বিমানবন্দরে ব্রিফিং: সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরকে ‘চমৎকার সূচনা’ আখ্যায়িত করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দীন বলেন, একে অন্যের উদ্বেগ দূর করা এবং পরস্পরের প্রতি সুপ্রতিবেশীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তিনি ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করেছেন৷ সাংবাদিকদের তিনি জানান, সুষমা স্বরাজ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের নেতৃত্বের সঙ্গে অব্যাহতভাবে কাজ করার ব্যাপারে আশাবাদী৷
ভারতের নতুন সরকার পূর্ণ মেয়াদে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে প্রস্তুত িক না, এ প্রশ্ন করা হলে আকবরউদ্দীন বলেন, ‘সরকার কাজ করে সরকারের সঙ্গে৷ ভারতের সরকার বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করবে৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো এ দেশের জনগণকেই সমাধান করতে হবে।’
বিভিন্নজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ: সকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এ সময় তাঁদের মধ্যে প্রায় আধা ঘণ্টা আলাপ হয়েছে।
এরপর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও গওহর রিজভী।
রওশনের সঙ্গে : সুষমা স্বরাজ গতকাল দুপুরে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করেন৷ দুজনের মধ্যে দুপুর পৌনে ১২টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক হয়। সুষমা এ সময় রওশনকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান রওশন এরশাদ। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা তাঁর সঙ্গে থাকা প্রতিনিধিদলের কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি৷ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না—জানতে চাইলে রওশন এরশাদ বলেন, এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তিস্তার পানি, ছিটমহল ও সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে রওশন বলেন, আলোচনা হয়েছে। আস্তে আস্তে এগুলোর সমাধান করা হবে।
মন্দিরে প্রার্থনা: গতকাল সফরের শেষ দিনের শুরুতেই সকালে পুরান ঢাকায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করেন সুষমা স্বরাজ৷ প্রার্থনায় তিনি বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক কামনা করেন৷ এ সময় মন্দিরে উপস্থিত পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে সুষমা স্বরাজ হিন্দিতে বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান৷ এ সম্পর্ক আরও জোরালো হবে। দুই দেশের সম্পর্কে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, তা দূর করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব৷ খোলা মন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি৷ কোনো ভুল-বোঝাবুঝি থাকবে না৷’
গত বুধবার রাতে তিন দিনের ‘শুভেচ্ছা সফরে’ ঢাকায় আসেন সুষমা স্বরাজ৷ সম্প্রতি ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটাই বাংলাদেশে সে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ের সফর৷