সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুম্বাই: লজ্জায়, ক্রোধে, অপমানে, মুখটা প্রায় লাল হয়ে গিয়েছে। ভারত অধিনায়কের চিরাচরিত এক বৈশিষ্ট্য হল, চরম যন্ত্রণাকেও তিনি বহির্বিশ্বে পেশ করে থাকেন ঠাট্টা-ইয়ার্কির মরীচিকায়। ভেতরে যা চলে, তাকে বাইরে বেরোতে দেন না। মিডিয়ার শত প্ররোচনামূলক প্রশ্নেও রাগেন না চট করে। যে বোঝার সে বোঝে। যে অনুভব করার, সে করে। ওয়াংখেড়ের বিপর্যয়-রাতে যে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে পাওয়া গেল, সে দিক থেকে তিনি খুব আলাদা কিছু নন। ঠোঁটে ক্লিষ্ট হাসি, মুখকে যথাসম্ভব অনাবেগী করে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। তবে এখন ক্রিকেট-জীবনের স্লগ ওভার চলছে তো, তাই মাঝেমধ্যে দু’একটা বেরিয়ে যায়।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকে শেষ কবে বলেছেন, আজ আর কী জিজ্ঞেস করবেন আপনারা? জিজ্ঞেস করার কি কিছু আছে আর!
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকে শেষ কবে বলেছেন, ভুল কোথায় হল আজ কেন জানতে চাইছেন? শুনে রাখুন, পুরোটাই ভুল হল! পুরা ম্যাচ হি গলত হো গ্যয়া!
বিদীর্ণ হাহাকারের মতো যা কানে ধাক্কা লাগবে। তিন ফুট দূরত্বে বসে থাকা ভারতের সর্বাধিনায়ককে দেখে মনে হবে, চারশো আটত্রিশের কষাঘাতে চুরমার লোকটাকে যদি এর চেয়ে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে বলা হত, ভাল হত। স্বাভাবিক। রবিবাসরীয় ওয়াংখেড়েতে যা ঘটে গেল, তার পর স্বাভাবিক না থাকাই তো স্বাভাবিক। সিরিজ নির্ণায়ক যুদ্ধে নেমে সেনাপতিকে যদি চারশো আটত্রিশের অপমান গলাধঃকরণ করতে হয়, নিজেকে কতটা মুখোশে ঢেকে রাখা সম্ভব? এবং মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সবচেয়ে মর্মান্তিক আঘাতের জায়গাটাও তো আন্দাজ করা যায়। চার বছর আগে ওয়াংখেড়েই তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট, তাঁর ব্যাট গোটা ভারতবর্ষকে উপহার দিয়েছিল ভুবনজয়ের রাত। চার বছর পর আবার ওয়াংখেড়ে, আবার সঙ্কটের মুহূর্তে এমএসডি। কিন্তু ক্রিকেট-নিয়তি অতি নিষ্ঠুর ভাবে এ বার তার নিজের অন্য দিকটার নগ্ন প্রকাশ ঘটাল। সোনার বদলে ধোনির মাথায় এ বার লজ্জার মুকুট। আনন্দের বদলে এ বার বিপর্যয়ের রাত। শীতল ঔদ্ধত্যের সেই বিখ্যাত ছবিটাও তো তার একক সিংহাসন হারাল। আজ থেকে ওয়াংখেড়ে যত বার বিশ্বজয়ের ছক্কা মেরে এমএসডির সেই তাচ্ছিল্যের ব্যাট ঘোরানো মনে করবে, ঠিক তত বার তার সঙ্গে আরও একটা ছবি আপনাআপনি জুড়ে যাবে।
ইমরান তাহিরের গুগলি ধরতে না পেরে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বোল্ড। অপসৃয়মান চেহারাটা আজও একটা ব্যাট ধরে। আজ শুধু সেটা নতজানু!
কোনও সন্দেহ নেই, এমএস ধোনি বিশ্বজয়ের মঞ্চে নিজের ক্রিকেট-জীবনের সম্ভবত জঘন্যতম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন। ভারত অধিনায়ক তিনটে যুক্তি দিলেন এমন চরম কলঙ্কের নেপথ্যে। এক, পেসারদের অতিরিক্ত শর্ট বল দেওয়া। তার উপর টিমের সমস্ত বোলার একযোগে ‘কোমায়’ চলে যাওয়ায় ব্যাপারটা আরও ভয়াবহ হয়ে গিয়েছে। দুই, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্যাচ পড়া। যেগুলো ধরলে ম্যাচের ভাগ্য পাল্টালেও পাল্টাতে পারত। তিন, ওয়াংখেড়ের পাটা উইকেট। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আশা করেন, দেশের মাটিতে স্পিনিং উইকেট পাবেন। জোহানেসবার্গে তো আর আশা করা যায় না!
ঠিক। কিন্তু তিনটে কারণের সঙ্গে চতুর্থ কারণও আছে, যা ধোনি বললেন না। সেটা তিনি নিজে। সেটা তাঁর অধিনায়কত্ব।
শোনা গেল, ওয়াংখেড়ের কমেন্ট্রি বক্সে ধোনির অধিনায়কত্ব দেখে উপস্থিত প্রাক্তনদের কেউ কেউ নাকি তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছেন। কোনও কোনও প্রখ্যাত প্রাক্তন বিরক্তিতে নাকি বলে ফেলেছেন যে, ধোনির ক্যাপ্টেন্সি ব্রেন ধার হারাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, ফুটন্ত ক্ষোভের পিছনে এঁদের যুক্তি, এবি ডে’ভিলিয়ার্সকে ক্রিজে নামতে দেখে তুমি বিরাট কোহলিকে দিয়ে বল করাতে পারো না। পার্ট টাইম বোলার দিয়ে এবিডি-র মতো আরডিএক্সকে সেট করতে দেওয়া অমার্জনীয়। বক্তব্য যুক্তিযুক্ত। ডে’ভিলিয়ার্স প্রথম গোটা কুড়ি বল কোনও প্রতিরোধের মুখেই পড়েননি। ধোনি তো তখন বিরাট, নইলে রায়নাকে দিয়ে করাচ্ছেন। কোনও এক হরভজন সিংহের (যিনি আজ তুলনায় ভাল) কথা তাঁর তো মনেই পড়ল না। এবি শেষ পর্যন্ত ৬১ বলে ১১৯ করে চলে গেলেন। ভুবনেশ্বর কুমারদের আগামী পাঁচ বছর ‘অ্যাসাইল্যামে’ পাঠানোর যথাযথ বন্দোবস্ত করে। কেউ কেউ বলতে পারেন, সেঞ্চুরি আরও দু’জন তো করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার। কুইন্টন ডি’কক বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, এক সময় ভিভিএস যা ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কপালে, তিনি এখন তা ভারতের। এই নিয়ে পাঁচটা সেঞ্চুরি হয়ে গেল ভারতের বিরুদ্ধে। ফাফ দু’প্লেসির শিট অ্যাঙ্করের ভূমিকায় অসাধারণ সেঞ্চুরিও নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমের খাতিরে ভোলা অসম্ভব। কিন্তু তবু ওঁরা নন।
নকআউট পাঞ্চে যদি কেউ ভারতকে সন্ধের মধ্যে রিংয়ের বাইরে ফেলে দিয়ে থাকেন, তা হলে তিনি ডে’ভিলিয়ার্স। এমন নয় যে, তিনি নামতেই হরভজন এলে কিছু হত। কিন্তু এটাও ঠিক যে, কিছু হলেও হতে পারত। ধোনি সেই চেষ্টাটা করলেন না। এবিকে আটকানো গেল না। রানটাও সম্ভাব্য সাড়ে তিনশো থেকে চারশো আটত্রিশে পৌঁছে গেল।
একবার সেট হয়ে যাওয়া এবি-কে থামানোর মতো অস্ত্র আর কোথায় ভারতের? ক্রিকেটের চলমান বিবর্তনকে আটকানো যায়? ক্রিকেটকে তো আর তিনি ক্রিকেটে আবদ্ধ রাখছেন না। তাঁর ব্যাটিংয়ে ক্রিকেট, হকি ও টেনিসের ককটেল থাকে। সোজা ডেলিভারিগুলোকে যে ভাবে তিনি মিড উইকেট আর মিড অন দিয়ে সচরাচর পাঠিয়ে থাকেন, দেখে তো মনে হয় ক্রসকোর্ট মারছেন! আচমকা ঝুঁকে পড়ে গ্যালারির ছাদে ফেলে দেওয়ায় মিশে থাকে পেনাল্টি কর্নারের সাদৃশ্য! এর সামনে ভুবনেশ্বর কুমারদের যা করা সম্ভব, সেটাই করেছেন। দশ ওভারে একশো দিয়েছেন।
ধোনির আরও একটা ব্যাপার বোঝা গেল না। দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসের অধিকাংশ সময় কেন যে তিনি আক্রমণাত্মক ফিল্ড প্লেসিংয়ে গেলেন না, বোঝা দুঃসাধ্য। হরভজন সিংহরা একটা সময় তো ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ পর্যন্ত পেলেন না। ঠিক ততটাই দুঃসাধ্য ভারতীয় ফিল্ডিংয়ের অনুধাবন। পাঁচটা ক্যাচ পড়ল সব মিলিয়ে। দু’টো লোপ্পা। আর ‘সুদৃশ্য’ ফিল্ডিং বিজ্ঞাপনের ব্যাখ্যায় একটা নমুনা পেশই বোধহয় যথেষ্ট। অমিত মিশ্রকে একবার ডেড বলে ঝাঁপিয়ে-টাপিয়ে তাকে আটকানোর চেষ্টা করতে দেখা গেল!
নির্যাসে এই, নিখাদ নির্যাতন। চারশো আটত্রিশ তাড়া রোজ-রোজ সম্ভব নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা একবার চারশো চৌত্রিশ তাড়া করে জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু ভারত তো দক্ষিণ আফ্রিকা নয়। তাদের কোনও এবিডিও নেই। অজিঙ্ক রাহানে প্রবল চেষ্টা করেছিলেন স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে আশার টিমটিমে প্রদীপ জ্বালাতে। কিন্তু তা নিভেও গিয়েছে এক সময়। আর চারশো আটত্রিশের যন্ত্রণাকে যদি ছেড়ে দেওয়াও হয়, যদি সরিয়ে রাখা যায় একপাশে, তা হলেও দুঃখ ছাড়া তো কিছু আর প্রাপ্তির খাতায় থাকে না। অনুষ্কা শর্মা মাঠে এসেছিলেন। বিরাটের আউট দেখে মুখে হাত দিয়ে বসে পড়তে হল। জাহির খান এসেছিলেন। যাঁকে দেখে সর্বত্র বলাবলি চলল, লোকটা এখনই অবসর নিয়ে নিল! এই তো অবস্থা বোলিংয়ের। অর্ধেক জাহিরও এই টিমে যথেষ্ট ছিল!
আরও একজন এসেছিলেন। যাঁকে দেখে ওয়াংখেড়েতে আবার সেই আদিম আওয়াজ। কিন্তু নীল শার্ট ঢুকলেন যখন, ভারতীয় ইনিংসের ‘শ্রাদ্ধানুষ্ঠান’ শেষলগ্নে। গোটা দু’য়েক বাকি। আর আগে এলেও বা লাভ কী হত?
সচিন রমেশ তেন্ডুলকর তো এখন প্রাক্তন, সাধারণ দর্শক মাত্র!