‘বড় বাপের পোলায় খায়’ ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়-‘আনাম খাসি’
আসমা খন্দকার.ঢাকা: পবিত্র মাহে রমজান মাস এলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে চকবাজার। আর এ ব্যস্ততা থাকে পুরো মাস। ইফতারির ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে উচ্চারিত হয় চকের নাম। চকবাজারের ইফতারির খ্যাতি আর ঐতিহ্যের কথা এখন আর কারও অজানা নেই। শুধু ইফতার সামগ্রী নিয়ে এমন বাজার দেশের আর কোথাও বসতে দেখা যায় না। বাহারি সব খাবার নিয়ে বসেছে ইফতারির বাজার। সব পদ ছাড়িয়ে যে নাম সবার মুখে মুখে আসে তা হলো ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। দুপুরের পর থেকেই হাঁকডাকের মাধ্যমে বিক্রি হয় ‘বড় বাপের পোলায় খায়।’ ঐতিহ্য আর খানদানি ইফতারি মানেই পুরান ঢাকার ইফতার সামগ্রী। মোগল আমলের ঐতিহ্যের ছাপ ও ছোঁয়ার এসব ইফতারি কালক্রমে ঢাকার সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়লেও এখনো স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান পুরান ঢাকাতেই।
প্রতি বছরের মতো এবারও সরগরম হয়ে উঠবে পুরান ঢাকার চকবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, চক সার্কুলার রোড, নর্থ সাউথ রোড, শাহী মসজিদ রোডসহ বিভিন্ন এলাকা। ইতোমধ্যে শত শত দোকান তৈরি হচ্ছে রকমারি ইফতারির পসরা সাজাতে। একেক দোকানে একেক ধরনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ইফতারি পণ্যের সমাহারে পুরান ঢাকা সাজবে বৈচিত্র্যময়তায়। এই রকমারি ইফতার বাজারের একটি জনপ্রিয় আইটেম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’।
নামকরা তথা ঐতিহ্যময় একটি ইফতারি পণ্য এটি। এর ঐতিহ্য প্রায় পঁচাত্তর বছরের। এটি তৈরিতে ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেমের সঙ্গে ১৬ ধরনের মসলা মিশিয়ে ৩১ পদের যে মিশ্রণ তৈরি হয় তার নামই ‘বড় বাপের পোলায় খায়।’ একটি বড় গামলায় এই ৩১ ধরনের খাবারসামগ্রী দুইহাতে ভালোভাবে মাখিয়ে তারপর ঠোঙায় করে বিক্রি করা হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরিকৃত এই খাবারটি কিনতে ছোট-বড় সব বয়সী রোজাদারের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যায়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এর স্বাদ নতুন প্রজন্মের কাছেও পৌছে গেছে। ছড়িয়ে গেছে এই মুখরোচক খাবারটির গল্প।
ঐতিহ্যবাহী এই ইফতারি আইটেমটি নিয়ে একটি ছড়ারও প্রচলন আছে, আর তা হলো ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়’। পুরান ঢাকার আদিবাসী, যাদের আমরা ঢাকাইয়া বলে জানি, তাদের আত্মসম্মানবোধ স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই। ক্রেতা আকর্ষণে সম্ভবত, এই আত্মমর্যাদায় আঘাত দিয়ে ব্যবসাটি চাঙ্গা করার অভিপ্রায়েই পাঁচমিশালি এই ইফতারি আইটেমটির নামকরণ করা হয়েছে।
সুপরিচিত হাজী শহীদ বাবুর্চির এক পদের খাবারের নাম এটি। এ দোকানের কর্মচারীরা জানান, এটি পুরনো ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাবার। তৈরি হয় ৩৬ প্রকারের উপকরণ আর ১৮ রকমের মসলা দিয়ে। চকের এ দোকানের সামনে দেখা গেল ভিড়। অনেকেই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ ইফতারি কিনছেন।
সম্প্রতি চকের ঐতিহ্য যেন আরও বেড়েছে। এখনকার ইফতার সামগ্রীও উৎকৃষ্ট মানের। বংশ পরম্পরায় তৈরি হয় চকের ইফতারি। যুগ যুগ ধরে ইফতার তৈরির একই ধারা এখানে চলে আসছে। সুতি কাবাব, জালি কাবাব তৈরি হয় সেই মুঘল ধাঁচে। আস্ত মুরগির রোস্ট, কবুতর রোস্ট, বঁটি কাবাব, জালি কাবাব, সুতি কাবাবের পাশাপাশি চকবাজারে উঠেছে আস্ত খাসির কাবাবও।
রয়েছে নানা ধরনের শরবত আর ফলের পসরা। আম, কাঁঠাল, বাঙ্গি, পেয়ারা, আপেল, নাশপতি সবই আছে সেখানে।
‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়’ পদের পরে যে নাম আসে তা হলো শাহী জিলাপি। এক থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত ওজন হয় একেকটি শাহী জিলাপির। বড় কড়াইয়ে বিশেষভাবে তৈরি এই জিলাপি বিক্রিও হয় প্রচুর।
এছাড়াও রয়েছে সুতি কাবাব, জালি কাবাব, শাকপুলি, টিক্কা কাবাব, ডিম চপ, কাচ্চি, তেহারি, মোরগ পোলাও, কবুতর ও কোয়েলের রোস্ট, খাসির রানের রোস্ট, দই বড়া, মোল্লার হালিম, নুরানি লাচ্ছি, পনির, বিভিন্ন ধরনের কাটলেট, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, ছানার মাঠা, কিমা পরোটা, ছোলা, মুড়ি, ঘুগনি, বেগুনি, আলুর চপ, পিয়াজু, ফুলরি, সমুচা।
এর পাশাপাশি আতা-আনারস থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফল, পিঠা-পায়েস, মিষ্টিসহ ইফতারের নানা সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে চকবাজারে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের চকের ইফতার সামগ্রী দিয়ে ইফতার করা চিরাচরিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। উপহার হিসেবেও পাঠানো হয় এই ইফতার। বাসায় তৈরির পাশাপাশি চকের খাবার দিয়েও ইফতার করেন তাঁরা।
চকের সেলিম বাবুর্চির রয়েছে দীর্ঘদিনের সুনাম। দূর-দূরান্ত থেকে সেলিম বাবুর্চির ইফতারি কিনতে ছুটে যান ক্রেতারা। চকবাজারে গিয়ে দেখা গেল সেলিম বাবুর্চির ইফতারি কিনতে মানুষের ভিড়। সেলিম বাবুর্চির ইফতার পণ্যের মধ্যে রয়েছে বড় আকারের আস্ত মুরগির রোস্ট।
প্রতিটির দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। এছাড়া তার আরেকটি খাবার ‘আনাম খাসি’ (আস্ত খাসি)। এর দাম সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা । অন্যান্য পদের মধ্যে তিনি বিক্রি করছেন কোয়েল পাখির রোস্ট; প্রতি পিস ৮০ থেকে ১০০ টাকা এবং চিংড়ি রোস্ট প্রতি পিস ২০০-২৫০ টাকা।
কয়েকজন ক্রেতা বলেন, “দামের কারণে নয়, ঐতিহ্যবাহী ইফতারির স্বাদ নিতেই এখানে ছুটে আসা। চকবাজারে ইফতারির যেমন নাম রয়েছে, স্বাদেও অতুলনীয়। তাই সুযোগ পেলেই এখানে ছুটে আসেন ক্রেতারা। তবে এবার ইফতার সামগ্রির দাম গত বারের থেকে একটু বেশি।