বড়লোকের পেটে ২০ হাজার কোটি ৮ ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক
শফিক রহমান : ব্যাংক ঋণের ২০ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে বড়লোকের পেটে চলে গেছে। এ টাকা উদ্ধার করতে না পেরে ৮টি ব্যাংকের ১৩ টা বাজার অপেক্ষা। এসব ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে গেছে। এগুলো বেশী ঘটছে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চয় (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকগুলোতে। অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিকরা নিজেদের মত করে নিজের ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর অন্যতম উদাহরণ ন্যাশনাল ব্যাংক!
অবস্থাদৃষ্টে ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা প্রকট হচ্ছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অভয় দেয়ার পরও ব্যাংক থেকে আমানত তোলার হার কমছে না। মঙ্গলবারও ৮ ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক দেখা গেছে। হাতিরঝিল থানা এলাকার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে মঙ্গলবার দুপুর ৩টার দিকে দীর্ঘ লাইন ধরে মানুষকে টাকা তুলতে দেখা গেছে। ওই ব্যাংকের ম্যানেজার জানালেন, সোমবার আমানতকারীরা ৬০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। টাকা তোলার হিড়িক যেন থামছে না। কাউকে বুঝিয়েও কাজ হচ্ছে না। গ্রাহকরা কোনো গুজবে কান দিচ্ছেন কিনা তাও বলছেন না।
সরেজমিনে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণও। আর এই ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চয় (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের আটটি ব্যাংক। চলতি সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ঘাটতির তালিকায় রয়েছে সরকারি অগ্রণী, বেসিক, জনতা ও রূপালী ব্যাংক। আর বেসরকারিতে বাংলাদেশ কমার্স, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের নাম।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে নানামুখী সুবিধা দিয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ পরিশোধেও বিভিন্ন ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের শুরুতে তা তুলে নেয়ার পর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ দেয় তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য এ প্রভিশন সংরক্ষণের নিয়ম রাখা হয়েছে।
ব্যাংক বিভিন্ন খাতে অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের উৎপাদন ও জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। ঋণ বা বিনিয়োগের সেই টাকা বিনিয়োগ গ্রাহকগণ অনেক সময় যথাসময়ে পরিশোধ করেন না। ফলশ্রুতিতে ঋণ বা বিনিয়োগ খেলাপি হয়ে যায়। গ্রাহকের আমানত সমূহ সংরক্ষণ করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। যে কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনগণের আমানত সমূহের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ধরণের সঞ্চিতি তহবিল সংরক্ষণরে মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এর মধ্যে অন্যতম হল নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন। মূলত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করায় একদিকে যেমন ব্যাংকের আয় কমে যায়, অপরদিকে ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান শক্তিশালী হয়। সুতরাং ব্যাংকের আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী করার জন্যই খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম আর সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। যার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া। খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো মালিকপক্ষের কর্তৃত্ব। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অসমপ্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন অনিয়ম সংগঠিত হওয়ার ফলে যে ঋণ খেলাপি সৃষ্টি হয়েছে তার যথাযথ প্রমাণ থাকার পড়ও উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ব্যাসেল আদর্শ অনুযায়ী ঋণ/বিনিয়োগ সঠিকভাবে না দেওয়ায় ব্যাংকখাতে বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হচ্ছে।
জানা গেছে, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্ন বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১১ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। জুন শেষে এ চার ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ১১ হাজার ১৭ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি বেসিক ব্যাংকে চার হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। জুনে যা ছিল চার হাজার ৪৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর পরেই অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি তিন হাজার ৫২১ কোটি টাকা। জুনে ছিল দুই হাজার ৯৭৩ কোটি ২২ লাখ টাকা।
তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। তিন হাজার ১৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। জুনে রূপালীর ঘাটতি ছিল দুই হাজার ৯৬২ কোটি ১০ লাখ টাকা৷ চতুর্থ অবস্থানে থাকা জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি কিছুটা কমে হয়েছে ৫৯৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। জুনে যা ছিল ৬৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
বেসরকারি চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি আট হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকেরই ঘাটতি সাত হাজার ৪৭৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। জুনে ঘাটতি ছিল সাত হাজার ১১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৪৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৪৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
বছরের তৃতীয় প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৮ হাজার ৬৮৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করেছে ৭৫ হাজার ১৫৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। ফলে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ১৩ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা।