ব্ল্যাকমানি-৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার
শফিক রহমান: এবার বাংলাদেশ থেকে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে বিদেশে। মার্কিন ডলারের বর্তমান বিনিময় হার প্রতি ডলার ৭৮ টাকা অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৭৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এ রিপোর্ট ওয়াশিংটন ভিত্তিক জিএফআই এর।
জিএফআই ওয়েবসাইট সূত্র বলেছে, এর বাইরেও নানা প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার হয়। তাই প্রকৃতপক্ষে তাদের হিসাবের চেয়ে বেশি অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে থাকে।গত এক দশকে পাচারের পরিমাণ বিবেচনায় বাংলাদেশ ২৬ নম্বরে রয়েছে। গতবারের রিপোর্টে বাংলাদেশ ছিল ৫১ নম্বরে। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে মোট ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা।
জিএফআই এর হিসেবে, ২০১৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়েছে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮৬ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু গত এক দশকে পাচার হয়েছে এর প্রায় ৮ গুণ। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে চীন থেকে, যার পরিমাণ এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি ডলার। পাচারের তালিকায় ভারত রয়েছে চার নম্বরে। ভারত থেকে ১০ বছরে ৫১ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের পরে রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। শীর্ষ দশে থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও নাইজেরিয়া।
সূত্র মতে, আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং করে বেশি মূল্য ও পরিমাণ দেখিয়ে ও রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং করে কম মূল্য ও পরিমাণ দেখিয়ে দেশ থেকে এই বিপুল পরিমান টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ওয়াশিংটনের গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচার বিষয়ে সর্বশেষ রিপোর্টে এসব তথ্য উল্লেখ করেছে। বুধবার সংস্থাটি ‘২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচার’ শিরোনামের এ রিপোর্ট প্রকাশ করে।
বুধবার ‘২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচার’ শিরোনামের এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আমদানিকারক ও রফতানিকারক দেশের তথ্যের মধ্যে গরমিল এবং ব্যালান্স অব পেমেন্টের ডাটার অসামঞ্জস্যতা থেকে জিএফআই অর্থ পাচারের প্রাক্কলন করে।
জিএফআইর রিপোর্টে বিশ্বের ১৪৯টি উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে গত এক দশকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে বাইরে চলে গেছে, তার প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর হিসাবের পদ্ধতিগত সংশোধনের কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আগের বছরগুলোর তথ্য সংশোধন হয়ে অনেকে বেড়েছে। জিএফআইর এ বছরের রিপোর্টের তথ্য অনুসারে, ২০১২ সালে ৫৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা (৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার) পাচার হয়। গত বছর প্রকাশিত রিপোর্টে এর পরিমাণ ছিল ১৭৮ কোটি ডলার বা প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। হিসাবের পদ্ধতি পরিবর্তন করায় আগের সব বছরের পাচারের অঙ্ক বেড়ে গেছে।
জিএফআইর রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং ও রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৮৩৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আইএমএফের কাছে প্রত্যেক দেশের পাঠানো আমদানি-রফতানির ডাটা বিশ্লেষণ করে যে গরমিল পাওয়া যায়, তা থেকেই এ প্রাক্কলন করা হয়েছে। এর বাইরে অন্য প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ‘হট মানি আউটফ্লোজ’ নামে এ ডাটা আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্ট রিপোর্ট থেকে নেওয়া।
জিএফআইর মতে, দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা, অপরাধী এবং কর ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীরা বিদেশে সম্পদ স্থানান্তর করতে অর্থ পাচার করে থাকে। করের স্বর্গ হিসেবে পরিচিত দেশে বেনামি কোম্পানিতে বিনিয়োগ এবং গোপন ব্যাংক হিসাবে রাখার জন্য অর্থ পাচার করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির মতে, তাদের এই প্রাক্কলন অত্যন্ত রক্ষণশীল। কেননা, এতে সেবা খাতের লেনদেন ও অপরাধ সংঘটনের জন্য নগদ লেনদেনের মতো ডাটা থাকে না। এদিকে গত জুন মাসে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৪’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ গচ্ছিত রয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ চার হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে সেখানে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় তিন হাজার ১৬০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নানা কারণে দেশ থেক টাকা পাচার হচ্ছে। বাণিজ্যের নামে অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশে তেমন শক্ত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অনেকেই অন্য দেশে বিনিয়োগ করছেন কিংবা সেকেন্ড হোম কিনছেন। তারা ভাবেন, এভাবে বাইরে টাকা নিয়ে গেলে শাস্তি হবে না। তবে প্রধান কারণ অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ পরিবেশের অভাব। আবার অনেকে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দেশে রাখতে চান না।তিনি বলেন পাচার প্রতিরোধ করতে হলে প্রত্যেকটি আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চেক ইন করা দরকার।