ব্রোথেলের শিশুরা যেভাবে বদলে যাচ্ছে-
টাঙ্গাইল থেকে দেলোয়ার হোসেন : বদলে যাচ্ছে ব্রোথেলের শিশুরা। তাঁরা আর অবহেলিত থাকতে চায় না। পড়ালেখার পাশাপাশি এমনসব ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই কিশোর-কিশোরীরা গঠন করেছে চাইল্ড লিড অর্গানাইজেশন (সিএলও)। এই সংগঠনের মোট ৫৬ জনের মধ্যে ২৩ জন ছেলে এবং ৩৩ জন মেয়ের সকলেই টাঙ্গাইল কান্দাপাড়া যৌনপল্লী ও হরিজন সম্প্রদায়ের। সমপ্রতি টাঙ্গাইল গিয়ে দেখা যায় এই শিশুরা নতুন জীবনের জন্য তৈরি হচ্ছে।
টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়া এসএসএস পৌর আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি ক্লাসরুম মুখরিত একদল কিশোর-কিশোরীর আলাপচারিতায়। তাদের কেউ বলে, তার ভালো লাগে দেয়ালিকায় লিখতে, কেউ বলে, বল্যবিবাহ বন্ধ করে কোনো মেয়েকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে পারলেই তার যত আনন্দ। আর একটি ছেলে জানায়, বখাটেরা স্কুলে আসার পথে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, এ বিষয়টি সে মেনে নিতে পারে না।
১৯৯৫ সালে হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য শিশু বিকাশকেন্দ্র নামে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুলটি। ২০১৫ সালে নবনির্মিত বিশাল ভবনে এসে উচ্চবিদ্যালয়ের যোগ্যতা অর্জন করে। স্কুলে এই সংগঠন পরিচালিত হয় বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর সোসাল সার্ভিস (এসএসএস)। স্কুলটি পরিচালিত হয় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা তেরে দেস হোমস্ নেদারল্যান্ডসের কারিগরি সহায়তায়। এস এস এস পৌর আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহম্মদ আব্দুস সবুর বলেন, ৪২৪ জন শিশুর মধ্যে ২০৮ জন কান্দাপড়া যৌনপল্লী ও হরিজন সম্প্রদায়ের, বাকিরা সবাই সাধারণ পরিবারের।
টাঙ্গাইল জেলার আরো কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেল, যৌনপল্লীর শিশুরা লেখা-পড়ার পাশপাশি গান গায়, নাচে, ছবি আঁকে, ভায়োলিন বাজায়, আবার আত্মরক্ষার জন্য কারাতে প্রশিক্ষণ নেয়। এই শিশুরাই দেশের বাইরে থেকে কারাতে খেলায় জয় করে আনছে গোল্ড মেডেল। গত প্রায় ২০ বছর ধরে তেরে দেস হোমস্ নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় টাঙ্গাইলের বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর সোসাল সার্ভিস (এসএসএস) কান্দাপাড়া পল্লীর শিশুদের পুনর্বাসন ও সমাজে মূলধারায় সম্পৃক্তকরণে কাজ করছে।
বাংলাদেশে শিশুদের বাণিজ্যিক যৌন শোষণের প্রতিরোধের লক্ষ্যে গত বছর থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় এবং তেরে দেস হোমস্ নেদারল্যান্ডস্-এর কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশের তিনটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঢাকার সোসাল এন্ড ইকনোমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম -সিপ, টাঙ্গাইলের সোসাইটি ফর সোসাল সার্ভিস (এসএসএস), এবং ঢাকার ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স (বিটিএস)-এর সমন্বয়ে কমব্যাটিং কমার্শিয়াল সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশন অব চিল্ড্রেন প্রকল্প নামে সাড়ে ৩ বছরের কনসোর্টিয়াম প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
বেসরকারি শিশু অধিকার শীর্ষক উন্নয়ন সংস্থা সোসাল এন্ড ইকনোমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম – সিপ এই কনসোর্টিয়াম প্রকল্পের সেক্রেটারিয়েটের ভূমিকা পালন করছে। ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার মিরপুরে সুবিধাবঞ্চিত মেয়েশিশু ও ছেলেশিশু বিশেষ করে যারা বাণিজ্যিক যৌন শোষণের শিকার এবং ঝুঁকিতে আছে তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন গঠনের লক্ষ্যে সিপ দুটি ড্রপ ইন-সেন্টার পরিচালনা করছে, টাঙ্গাইলে সোসাইটি ফর সোসাল সার্ভিস (এসএসএস) কান্দাপাড়া ব্রোথেলের যৌন কর্মীদের শিশু সন্তানদের পুনর্বাসন ও মূলধারার সমাজে পুন:একত্রীকরণের লক্ষ্যে টাঙ্গাইলের মগড়া ইউনিয়নের কুইজবাড়ি এলাকায় সোনার বাংলা চিল্ড্রেন হোম নামে একটি আবাস কেন্দ্র পরিচালনা করছে।
এবং ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স (বিটিএস) ঢাকা ও টাঙ্গাইলে শিশুদের মনোসামাজিক সেবা প্রদান করছে। স্কুলের পাশাপাশি আছে টাঙ্গাইল শহর থেকে একটু দূরে সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের কুইজবাড়ির সোনার বাংলা চিলড্রেন হোম, রসুলপুর বিক্রমহাটিতে আছে এসএসএস-এর ভোকেশনাল ট্রেনিং ইস্টিটিউট। এসএসএস-এর সমাজের ঝরে পড়া দরিদ্র ১০ জন শিক্ষার্থী আছে।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে তারা হাইস্কুল যায়। হোমের অনেক ছেলে-মেয়ে এখন রাজধানীর কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। চার বছর বয়স হলেই যৌনপল্লীর শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসা হয় বলে জানান এসএসএস-এর দুর্গা দত্ত। তিনি বলেন, যৌনপল্লীর মায়েদের কাউন্সেলিং করা হয়, যেন সন্তানদের তারা এই পেশাতে না আনেন। অনেক মা বিষয়টি বুঝলেও দারিদ্রের কাছে তারা পরাজিত হন বলে জানান তেরে দেস হোমস্ পরিচালক মাহমুদুল কবির।