`ব্যবসায়ীদের সমর্থন ছাড়া কোনো দল কর্মসূচি সফল করতে পারবে না’
কলিম শরাফি.ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম খানের জন্ম ঢাকায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিস্ট থেকে পিএইচডি করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ‘কৃষকসমাজ’। তিনি দারিদ্র্য, সমাজতত্ত্ব, শিশুশ্রম, সামাজিক শোষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। কৃষকসমাজের ওপর করা তাঁর গবেষণাগ্রন্থটি আন্তর্জাতিকভাবে খুবই আলোচিত। বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সমাজের ওপর তার প্রভাব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক পরিকাঠামোর নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন।
প্রশ্ন : নানা দিক থেকে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রতিনিয়ত আমাদের অর্জনকে, সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে- একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে বিষয়টিকে কিভাবে দেখবেন?
= বাংলাদেশ অনেক অর্থেই সম্ভাবনার দেশ। অর্থনৈতিক দিক থেকে এর সম্ভাবনা যেমন বারবার নজরে আসছে, তেমনি সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আমরা মুসলিম সেক্যুলার সংস্কৃতি ধারণ করি। এখানে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামী সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে। ইসলামের দুটি ধারা- ওহাবি ও সুফি। এই দুটি ধারার মধ্যে সুফিবাদী ধারা এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী। একটি উদাহরণ দিতে পারি। যেমন, এবার বনানী পূজাম-পের আয়োজক কমিটির ব্যক্তিরা আমাকে জানিয়েছিল, তাদের দর্শনার্থীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ছিল মুসলিম। একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ থেকেই কিন্তু আমরা বলতে পারি, বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং মেনে নিয়েছে, যে যার ধর্ম পালন করবে এবং একজনের ধর্মীয় উৎসবে আমিও অংশগ্রহণ করতে পারি। এটিতে কোনো পাপ নেই। এই যে পাপ-পুণ্যের বোধটা বড় হয়ে এসেছে। একটি সামগ্রিক বোধের পরিবর্তন ঘটেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা কাম্য নয়।
প্রশ্ন : এখনো তো প্রতিদিন নানা ঘটনাই ঘটছে। বিশেষত, নারী নির্যাতন কিংবা নানা সামাজিক অনাচার প্রতিদিনের পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে। সেগুলোর বিশেষ কি কোনো পরিবর্তন ঘটেছে?
= সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ হচ্ছে। আয়তন বড় হলে এখানে অনেক কিছু নতুন করে প্রবেশ করে। সংস্কৃতির বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন একটি বড় ভূমিকা রাখছে; যদিও বিশ্বায়ন সব করছে না। শাহবাগ আন্দোলন বিশ্বায়নের কারণে আসেনি। শাহবাগ এসেছে বাংলাদেশের ভেতরের যে একটা অগ্রগামী সংস্কৃতির চর্চা হয়, তার ধারাবাহিকতায়। আমাদের ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, এখানে রবীন্দ্রনাথের প্রতি মানুষের সম্প্রীতি। এই সব কিছু মুক্তিযুদ্ধের পরে নয়, সেই পাকিস্তানি আমল থেকেই ছিল। বংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে উন্নয়ন, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ। এসব নিয়েই বাংলাদেশ। সুতরাং সেখানে এখন যখন সামাজিক অন্যায়গুলো হচ্ছে, যেটা খুবই প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব- এসবের কারণে যখন কোনো অন্যায়ের বিচার হয় না তখন সেই অন্যায়কারীর সাহস বেড়ে যায়। সে ভাবে কই, কিছুই তো হলো না। এটি দেখে আবার অন্যরা উৎসাহিত হয়। এ জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতায় যে-ই থাকুক না কেন, তাকে নিশ্চিত করতে হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। রাজনৈতিক ক্ষমতার সেই অন্যায়কারী আবার এসে সমাজের মধ্যে আশ্রয় নেয়। রাজনীতি হলো ক্ষমতার কেন্দ্র। নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে কার্যকর করা- সবটাই তার কাজ। পদাধিকারবলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সমাজেরও অভিভাবক। তাই যে-ই ক্ষমতায় থাক না কেন, তাকে অন্যায়কারীর বিচার করতে হবে। আর রাজনৈতিক অস্তিরতার কারণে এসব প্রবণতাও বাড়তে থাকে। বর্তমানে কয়টি সামাজিক অন্যায়ের বিচার হয়? হয় না, তাই এটি যেমন সুশাসনের সঙ্গে জড়িত, তেমনি সমাজের শৃক্সখলার সঙ্গেও জড়িত।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যক্তি মানুষের ওপরও নানা ধরনের ক্রিয়া করে। রাষ্ট্রের ব্যর্থতা তাকে প্রভাবিত করে।
= দেখুন, বর্তমানে আমরা যে বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যে আছি, সেই ব্যবস্থাটিই একটি বড় অস্থিরতার কারণ। এ ব্যবস্থাটিই এখন ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব। ব্যবসায়িকভাবে যেমন একটি গ্রট্টপের সঙ্গে আরেকটি গ্রট্টপের দ্বন্দ্ব থাকে, তেমনি রাজনৈতিকভাবেও প্রধান দুই দলের দ্বন্দ্ব থেকে। আমি এভাবে দেখতে চাই, অর্থনীতি আবার যখন বড় হবে, তখন সেটি অনেকটা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে। কেকের সাইজটা যদি বড় হয়ে যায়, তাহলে অনেক পিস করা যাবে। অদূর ভবিষ্যতে এটিও হয়তো ঘটবে যে মির্জা ফখরুল একটি অংশ পাবে। মোহাম্মাদ নাসিমও একটি অংশ পাবে। তফাতটা কমে আসবে। জামায়াতে ইসলামী আজ হরতাল ডাকার পর আমরা দেখছি সেটা আর সফল হচ্ছে না। কেন? কারণ সেখানে ব্যবসায়ীদের সমর্থন নেই। এখন আমাদের অর্থনীতি সেই শক্তি অর্জন করেছে যে ব্যবসায়ীদের সমর্থন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল আর কোনো কর্মসূচি সফল করতে পারবে না। সেই কর্মসূচি আওয়ামী লীগের হোক বা বিএনপির হোক।
সমাজ হলো সব কিছুর সমন্বয়। সমাজের মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এক কথায় মানুষের জীবন যা দিয়ে তৈরি তার সবটাই সমাজের মধ্যে থাকে। আইনশৃক্সখলা, নিরাপত্তা সবটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যখন হরতাল হয় কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশৃক্সখলা চলে তখন কোনো রাষ্ট্র সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে না। পুলিশকে যদি রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সদা নিয়োজিত থাকতে হয়, তাহলে চোর-ডাকাতদের ধরবে কে? জনগণের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়গুলোতেও যে মনোযোগ দিতে পারবে না। আর যখন তার নিজস্ব কাজ ব্যাহত হবে তখন স্বাভাবিকভাবে অন্য দিকগুলো উপেক্ষিত হবে। হরতালের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিকমতো চলে না। ফলে শিক্ষা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। সমাজ হলো একটি বৃক্ষের মতো। একটি গাছকে যদি ঠিকমতো বাড়তে দেওয়া না হয়, ক্রমাগত ঝাঁকুনি দিতে থাকা হয়, তাহলে তার স্বাভাবিক বিকাশ হবে না। তাকে স্বস্তি দিতে হবে, তাহলেও তো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে। আর তার বিকাশে বাধা দিলে সে কুঁকড়ে যাবে, নষ্ট হবে। সমাজের যখন সার্বিক নিরাপত্তা ব্যাহত হয়, অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তখন ব্যক্তি হতাশ হয়।
প্রশ্ন : কিভাবে এই হতাশা প্রকাশিত হতে পারে?
= হতাশা একেক শ্রেণির মধ্যে একেকভাবে প্রকাশিত হয়। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে পিছিয়ে যান। কেউ বিনিয়োগ করলেন; কিন্তু যদি পরিকল্পনামতো তিনি তাঁর লাভ দেখতে না পান, তবে অবশ্যই তিনি এগোবেন না। আবার তরুণদের মধ্যে একভাবে প্রভাব পড়ে। সে দেশ ছেড়ে চলে যেতে উৎসাহী হয়। সমাজের অস্থিরতাটাই ব্যক্তির মধ্য দিয়ে নানা মাত্রায় আসে। হতাশ মানুষ আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়। একটি সামগ্রিক হতাশা সর্বত্র বিরাজ করে। নৈরাজ্য বাড়ে, সামাজিক মনোমালিন্য বাড়তে থাকে।
দেখুন, আজকে বাংলাদেশের অনেক অর্জনের মধ্যে একটি বড় অর্জন নারীদের এগিয়ে যাওয়া। এখানে কিন্তু শুধু নারীর ক্ষমতায়ন নয়, নারীর মধ্যে সার্বিক একটি মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়েছে। এখন নারীরা এটি ভাবছে না যে শুধু ঘরে বসে থাকবে। ভাবছে, তারও কিছু করার আছে। সুতরাং সে জীবনসংগ্রামে অংশগ্রহণ করছে। এটি খুবই ইতিবাচক দিক। অন্য অনেক কিছু হয়তো করা যেত। প্রযুক্তির উন্নয়ন কিংবা অনেক বিষয় অর্থ দিয়ে মীমাংসা করা যায়। কিন্তু একটি মনোভাবের পরিবর্তন, মানসিকতার পরিবর্তন কিন্তু খুব সহজ কিছু নয়। এটি বাংলাদেশে ঘটে গেছে। তাই এখন হয়তো অনেক ছোট সমস্যা দ্রুত সমাধানও হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : ব্যক্তি সেখানে কিভাবে উত্তরণ পেতে পারে?
= এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যক্তির নিরাপত্তাহীনতা থাকে তখন ব্যক্তির কিছুই করার থাকে না। কারণ রাজনৈতিক দল যখন কর্মসূচি পালন করে তখন ব্যক্তি একা বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে না। আমি একজন সিভিলিয়ান, আমি কি এখন দাঁড়িয়ে বলতে পারব এসব যা হচ্ছে তা আমি মানি না। সেটা হয় না। ব্যক্তিকেও গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক শক্তির বিপক্ষে শক্তি গড়ে তুলতে হয়। সেটি যেহেতু এখনো বাংলাদেশে হচ্ছে না বা তেমন তো জনগণের শক্তি বা মতকে ধারণ করতে পারে- এমন পার্টিও নেই। তাই অনেক সময় এতে ব্যক্তিহতাশা বাড়ে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, রাজনৈতিক শক্তিকে রাজনৈতিকভাবেই পরাস্ত করতে হয়। একা বা একক ব্যক্তি সেটা অপছন্দ হলেও কিছু করতে পারে না।
প্রশ্ন: হতাশার মধ্যে বড় অর্জন; কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি ঠিক না থাকলে এই অর্জনকে ধরে রাখা যাবে কি?
=এ থেকে উত্তরণের উপায় খুব সহজ এবং কঠিন। আমরা সবাই জানি কী করতে হবে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল জানে কী করতে হবে। তারা যেন সেটা করছে না বা করতে চাইছে না। এ থেকে উত্তরণ দুইভাবে হতে পারে। মানুষ দুইভাবে শেখে- এক. থিওরি থেকে (তত্ত্ব), দুই. বাস্তব থেকে। আমরা যদি তত্ত্ব থেকে না শিখি, তাহলে আমাকে বাস্তব থেকে শিখতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা বাস্তবতা থেকেও শিখতে পারেন। শক্তির ভারসাম্য রক্ষিত না হলে হয়তো একসময় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই চাপ প্রয়োগ করবে। মানুষের হতাশা, নিরাপত্তাবোধ আরো তীব্র হবে। তবে আমার কথা হলো, ‘সুন আর দ্য বেটার’ যত আগে হয় সেটাই ভালো। সেটি হবে সবার জন মঙ্গলজনক।