বেশুমার অনিয়ম দুর্নীতি যমুনা ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার ঋৃণ লুটপাটে কর্তারা
এস রহমান : বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া শুরু করেছে যমুনা ব্যাংকে। চলছে বেশুমার অনিয়ম দুর্নীতি। ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্তৃক গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ, নামে-বেনামে ভুয়া গ্রাহককে ঋণ দেওয়া, ঘুষের বিনিময়ে ঋণ অনুমোদন, এলসি জালিয়াতি, ভুয়া এফডিআরের বিপরীতে ঋণ প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকটির শীর্ষ কর্তারা।
এমনকি পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্যও তাদের পছন্দের গ্রাহককে ঘুষের বিনিময়ে ঋণ পাইয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে ব্যাংকটির আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকটি যে কোনো সময় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে যমুনা ব্যাংককে একাধিকবার সতর্কও করা হয়েছে। এর পরও কমছে না ব্যাংকটির অনিয়ম, দুর্নীতি। এদিকে মোটা টাকার বিনিময়ে ব্যাংকটির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে মেতে উঠেছেন। এমনকি কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ইচ্ছামাফিক বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে ব্যাংকটিতে প্রভাবশালী পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এ ধরনের অভিযোগ গড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যন্ত।
সম্প্রতি নাজমুস সা’দাত (ছদ্মনাম) নামে এক ব্যক্তি সিনিয়র অফিসার পদে দরখাস্ত করে লিখিত পরীক্ষায় দশম স্থান অধিকার করলেও তাকে ভাইভার জন্য ডাকা হয়নি। নিয়োগও দেওয়া হয়নি। অথচ একই পদে একাধিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ পর্যন্ত করেননি। এ নিয়ে নিয়োগবঞ্চিত ওই চাকরিপ্রার্থী বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকই।
ফলে এখানে অনিয়ম, দুর্নীতির সুযোগ অনেক কম। এর পরও এমন ঘটনা ঘটে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্যই তা খতিয়ে দেখবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা। এদিকে যমুনা ব্যাংকের কুমিল্লা শাখার এক গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকের কুমিল্লা শাখার ব্যবস্থাপক মোশারফ হোসেন সেলিমের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার তিনটি তদন্ত দল কুমিল্লায় যায়। একটি দল ইতিমধ্যে ঢাকায় ফিরে এসেছে। বাকি দুটি দল কুমিল্লায় অবস্থান করছে। তারা ভুক্তভোগী গ্রাহক ও অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলেছে।
ঢাকায় ফিরে তারা একটি প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি মোশারফ হোসেন সেলিম যমুনা ব্যাংকের কুমিল্লা শাখায় যোগ দেন। এর পর নানা সময় তিনি ব্যাংকের বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ার নামে তাদের সই করা খালি চেক নিয়ে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিতে থাকেন। একই সঙ্গে জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাব থেকেও টাকা তুলে নিয়েছেন তিনি।
এভাবে তিনি অন্তত ২০ জন গ্রাহকের অর্ধকোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নিয়েছেন। এ বিষেয় একাধিক মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। সূত্র জানায়, ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ঋণ কেলেঙ্কারি বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতির সঙ্গে যমুনা ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার জালিয়াতিতে ফেঁসে যাচ্ছে যমুনা ব্যাংক।
যমুনা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেওয়া ১৬৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বিসমিল্লাহ গ্রুপের কাছ থেকে তুলতে পারছে না যমুনা ব্যাংক। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ওই জালিয়াতির সঙ্গে যমুনা ব্যাংকের কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকতে পারে। মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে হয়তো ওই কর্মকর্তা বিসমিল্লাহ গ্রুপকে ঋণ পাইয়ে দিয়ে থাকতে পারেন। তবে এ ব্যাপারে পরিষ্কার তথ্য পেতে আরও অধিক তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসব ঘটনায় ব্যাংকটিতে গ্রাহক পর্যায়ে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য গ্রাহক আমানত তুলে নিচ্ছেন। ডিপোজিট ভেঙে ফেলছেন। এ ছাড়া প্রায় দুই বছর আগে যমুনা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ১০৬ কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ায় এ নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটির দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানও অব্যাহত রয়েছে।
ইতিমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এদিকে ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার কয়েকটি শাখায় খোলা ১৩টি এলসির বিষয়ে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এর মধ্যে দুটি এলসির টাকা প্রায় দেড় বছর পর পরিশোধ করা হলেও বাকি ১১টির বিপরীতে ৪ কোটি ৬৫ লাখ ২২ হাজার ২৪৮ টাকা ব্যাংকটির কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা যায়।
অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তারা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মোট আট কোটি টাকা মূল্যের এলসির টাকা জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বিসমিল্লাহ গ্রুপকে দেড় হাজার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ দিতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যমুনা ব্যাংক। এই ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তা, এমনকি একজন প্রভাবশালী পরিচালকও এর সঙ্গে জড়িত বলে মনে করে দুদক। শুধু তা-ই নয়, বছর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণও বেড়েছে। কমেছে আমানত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বেসরকারি খাতের যে কয়েকটি ব্যাংকে গ্রাহক হয়রানি হয়, এর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যমুনা ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে প্রতিদিনই এ ব্যাপারে একাধিক অভিযোগ জমা পড়ছে বলে জানা গেছে।