বেতন-ভাতা বাগিয়ে নিয়ে ওরা ১০ জন এখন শীর্ষ ক্রোড়পতি
বিশেষ প্রতিনিধি : বেতন-ভাতা বাগিয়ে নিয়ে ওরা ১০ জন এখন শীর্ষ ক্রোড়পতি বনে গেছেন একেকজন। অনেকের ব্যাংক হিসাবে রয়েছে কোটি টাকার ওপরে। দেশের সরকারি-বেসরকারি ৪৮টি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য উদঘাটন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেতন-ভাতা বাগিয়ে নিয়ে শীর্ষ ক্রোড়পতি বনে যাওয়া কর্মকর্তারা দেশীয় ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।বেসরকারি ব্যাংক ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব পালন করছেন আলী রেজা ইফতেখার। ২০০৭ সাল হতে এই দায়িত্ব পালন করছেন সেই হিসাবে বেতন-ভাতা বাবদ আলী রেজা ইফতেখারকে প্রতিমাসে গড়ে ১৭ লাখ ১ হাজার ৯৯ টাকা বেতন দিয়েছে ওই ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালে দেশী ব্যাংকগুলোর মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ বেতন-ভাতাপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা! এরপূর্বে ২০১৫ সালেও ১ কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৮ টাকা বেতন-ভাতা নিয়ে দেশী ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতনধারী প্রধান নির্বাহী ছিলেন তিনি।
আরেকটি দেশী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে ২০১৬ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে বেতন-ভাতা পান দ্য সিটি ব্যাংকের সোহেল আরকে হোসেন।
উচ্চবেতন-ভাতায় শীর্ষ ১০ প্রধান নির্বাহীর মধ্যে আরও রয়েছেন যথাক্রমে: মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আনিস এ খান
ব্যাংক এশিয়ার মো. আরফান আলী, এক্সিম ব্যাংকের ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া, আইএফআইসি ব্যাংকের এম শাহ আলম সারওয়ার, উত্তরা ব্যাংকের মোহাম্মদ রবিউল হোসেন, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ফরমান আর চৌধুরী, ওয়ান ব্যাংকের এম ফখরুল আলম, ও ব্র্যাক ব্যাংকের সেলিম আরএফ হোসেন।
দ্য সিটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী সোহেল আরকে হোসেন গত বছর বেতন-ভাতা বাবদ ব্যাংক হতে পেয়েছেন ১ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন তিনি।
প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতা বাবদ তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হিসেবে রয়েছেন বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী আনিস এ খান ২০১৬ সালে বেতন-ভাতা বাবদ মোট পেয়েছেন ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সেই হিসাবে বেতন-ভাতা বাবদ মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক প্রতিমাসে তাঁকে পরিশোধ করেছে গড়ে ১৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা। এর পূর্বে ২০১৫ সালে প্রধান নির্বাহী হিসেবে আনিস এ খান ১ কোটি ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বেতন-ভাতাদি পেয়েছিলেন।
আনিস এ খান প্রধান নির্বাহীদের বেতন-ভাতা প্রসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, একজন প্রধান নির্বাহীকে একটি ব্যাংকের সবকিছুই নখদর্পণে রাখতে হয়। কারণ ব্যাংকের যেকোনো ভালো-মন্দের দায়দায়িত্ব প্রধান নির্বাহীর ওপর বর্তায়। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে প্রায় তিন দশক চাকরি করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একজন ব্যাংকার এমডির দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
তবে সে সময় এমডিরা ব্যাংকের নিয়মিত কর্মকর্তা না হয়ে বরং চুক্তিভিত্তিক কাজ করে থাকেন। সে কারণে এমডিরা নির্দিষ্ট বেতন-ভাতা ছাড়া অন্য কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা পান না। এমডিদের কোনো প্রভিডেন্ট ফান্ডও নেই। এছাড়া বেতন হতে উচ্চহারে সরকারকে করও পরিশোধ করতে হয়। তাই সব মিলিয়ে ব্যাংকের এমডিদের বেতন-ভাতা অন্যান্য খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলতে হবে।
শীর্ষ নির্বাহীর বেতন-ভাতা ব্যয়ের দিক থেকে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংক এশিয়া। প্রধান নির্বাহী মো. আরফান আলী গত বছর বেতন-ভাতা হিসেবে ব্যাংকটি হতে পেয়েছেন ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এই হিসাবে ব্যাংক এশিয়া হতে তিনি প্রতিমাসে গড়ে ১৩ লাখ ৭ হাজার টাকা আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন।
২০১৬ সালে উচ্চবেতনভুক্ত প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে পঞ্চম স্থানে আছেন এক্সিম ব্যাংকের ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া। এক্সিম ব্যাংক গত বছর প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতাদি বাবদ ব্যয় করেছে ১ কোটি ৫১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ব্যাংক হতে বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিমাসে গড়ে ১২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা পেয়েছেন। ২০১৫ সালে ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত ব্যাংকটি শীর্ষ নির্বাহীর বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় করে ১ কোটি ২২ লাখ টাকা।
এরপর আছেন আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি ও সিইও এম শাহ আলম সারওয়ার। বেতন-ভাতা বাবদ ২০১৬ সালে তিনি পেয়েছেন ১ কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই হিসাবে আইএফআইসি ব্যাংক প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিমাসে তাঁর পিছনে ব্যয় করেছে ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এরপর আছেন উত্তরা ব্যাংকের এমডি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল হোসেন। তিনি প্রতিমাসে গড়ে ১১ লাখ ২৯ হাজার টাকা বেতন-ভাতা পেয়েছেন। ২০১৬ সালে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বেতন-ভাতা নিয়ে উচ্চবেতনভুক্ত শীর্ষ নির্বাহীদের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছেন এই কর্মকর্তা।
অস্টম স্থানে রয়েছেন শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালনকারী ফরমান আর চৌধুরী। বেতন-ভাতা বাবদ গত বছর (২০১৬) ব্যাংকটি হতে তিনি পেয়েছেন ১ কোটি ৩৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে তিনি প্রতিমাসে গড়ে বেতন-ভাতা পেয়েছেন ১১ লাখ ২৯ হাজার টাকা।
অপরদিকে প্রতিমাসে গড়ে ১১ লাখ ১১ হাজার টাকা বেতন-ভাতা পেয়েছেন বেসরকারি খাতের অপর ব্যাংক ওয়ান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. ফখরুল আলম। তিনি ২০১৬ সালে বেতন-ভাতাদি বাবদ ব্যাংকটি হতে পেয়েছেন ১ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। দেশের উচ্চবেতনভুক্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে তার অবস্থান হলো নবম।
দেশের উচ্চবেতনভুক্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে দশম স্থানে রয়েছেন বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সেলিম আরএফ হোসেন। তিনি ২০১৬ সালে ব্যাংকটি হতে বেতন-ভাতাদি বাবদ আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন ১ কোটি ৩৩ লাখ ৯ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতিমাসে ব্র্যাক ব্যাংক প্রধান নির্বাহীকে বেতন-ভাতা বাবদ পরিশোধ করেছে ১১ লাখ ৯ হাজার টাকা।
শীর্ষ নির্বাহীদের বেতন-ভাতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংবাদ মাধ্যমকে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছেন, এক ব্যাংকের এমডি বা ডিএমডিকে উচ্চবেতন দিয়ে অন্য ব্যাংক টেনে নিয়ে যাচ্ছে। টানাটানির কারণে ব্যাংকের এমডিদের উচ্চবেতন হয়ে হচ্ছে। ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়া এবং যোগ্য প্রধান নির্বাহী সংকটের কারণেই মূলত বাধ্য হয়েই এমডিদের বেতন বাড়াচ্ছে পর্ষদ।
তিনি বলেছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ হতে ব্যাংকের এমডিদের বেতন-ভাতা নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। একটি ব্যাংকের এমডির বেতন সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন কতো হবে, ওই নীতিমালায় সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতে পারে। কারণ হলো বর্তমানে ব্যাংক এমডিদের বিদ্যমান বেতন দেশের কোনো বেতন কাঠামোর সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেছেন, সরকারি-বেসরকারি যেকোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচালনা পর্ষদের পক্ষ হতেই নিয়োগ দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করে এমডি নিয়োগের অনুমতি চেয়ে আবেদন পাঠালে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি যাচাই করে নিয়োগ অনুমোদন করে। এক্ষেত্রে এমডিদের বেতন কতো হবে, সেটিও ব্যাংকের পক্ষ হতেই নির্ধারণ করা হয়। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিকপক্ষ হতে এমডিদের বেতন কাঠামো নিয়ে কোনো আবেদন জানালে সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যালোচনা করে দেখতে পারে।