বেকারত্ব দূর করতে সামাজিক ব্যবসা
শফিক আজিজি:
ড. ইউনূস বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা দিয়েই এই বেকারত্বের সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন ও উদ্যোগ দিয়ে বেকারত্ব দূর করতে চাই। পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতি আসবে, যখন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না।’ একজন সুস্থ শরীরের মানুষ বেকার থাকবে, এটা হতে পারে না। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু টাকা আয় করতে চাই। এটা হতাশাজনক। আমাদের সমাজের দায়বদ্ধতা কম। আমরা রোবটের মতো আচরণ করি।’ তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তোমরা ব্যবসার ধারণা নিয়ে আসো। আমরা তহবিল দিব।’
মোহাম্মদ ইয়াসিনের বয়স মাত্র ২৩ বছর। বাড়ি চাঁদপুরের আনকিলা গ্রামে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান ইয়াসিন ২০০৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষার পর একটি ক্যারম বোর্ড কারখানায় কাজ শুরু করেন। পরে ২০০৯ সালে ওই কারখানা কিনে নেন ইয়াসিন। নাম দিয়েছেন মেঘনা ক্যারম বোর্ড ফ্যাক্টরি। এখন তাঁর অধীনে চারজন কর্মী কাজ করছেন। এটি একটি সামাজিক ব্যবসা। এখানে কোনো মুনাফা নেন না ইয়াসিন। তবে সম্মানী পান।
এই নবীন উদ্যোক্তা গত মে মাসে অনুষ্ঠিত পঞ্চদশ ইউনূস সেন্টার সোশ্যাল বিজনেস ডিজাইন ল্যাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তাঁর কারখানাটিতে বিনিয়োগ করেছে গ্রামীণ ট্রাস্ট।
এভাবেই নিজের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প করলেন মোহাম্মদ ইয়াসিন। গতকাল শনিবার সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষে র৵াডিসন হোটেলে আয়োজিত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার একটি অধিবেশনে কথা বলেন তিনি। তাঁর মা আয়েশা বেগম গ্রামীণ ব্যাংকের চাঁদপুরের শাহরাস্তি শাখার সদস্য। ইয়াসিন গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বিতীয় প্রজন্ম। এভাবেই গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্যরা উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। তাঁরা আর চাকরিপ্রার্থী নন, চাকরিদাতা।
এই হলো বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবসার উদাহরণ। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামাজিক ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপের দেশ আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় সামাজিক ব্যবসার আওতায় বৃদ্ধনিবাস করা হয়েছে। ২০১২ সালে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে এই বৃদ্ধনিবাসে ২৫০ জন বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন।
সামাজিক ব্যবসা দিবসের অনুষ্ঠানে এসব কথা জানালেন ইউনূস সোশ্যাল বিজনেসের পরিচালন কর্মকর্তা লিওনর ক্লেইকওফ। তিনি মনে করেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে একদিকে বয়স্ক নাগরিকদের প্রতি সমাজের দায়বদ্ধতা পূরণ করা হয়, আবার বয়স্ক কেন্দ্রে সেবিকাদের নিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানও হচ্ছে।
শুধু আলবেনিয়া নয়; নেপাল, ভিয়েতনাম, চীন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, হাইতি, যুক্তরাষ্ট্র, উগান্ডাসহ পৃথিবীর দেশে সামাজিক ব্যবসার প্রসার ঘটছে। সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সামাজিক ব্যবসা হলো এমন উদ্যোগ, যেখান থেকে মুনাফা বা লভ্যাংশ নেওয়া যায় না। উদ্যোক্তারা মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ করেন৷ আর প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতোই পরিচালিত হয়।
ইউনূস সেন্টার পাঁচ বছর ধরেই প্রতি ২৮ জুন সামাজিক ব্যবসা দিবস পালন করে আসছে। এই দিন সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে আসেন। দিনব্যাপী নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। এবারের িদবসের মূল থিম হলো, ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা’।
গতকাল সামাজিক ব্যবসা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বেকারত্ব দূর করতে সামাজিক ব্যবসা একটি কার্যকর ব্যবস্থা। বেকারত্ব এখন পুঁজিবাদের নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ইউরোপের স্পেনের অর্ধেক তরুণ-তরুণীই বেকার। তাঁরা স্পেনের হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম। নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছেন না তাঁরা।
ড. ইউনূস বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা দিয়েই এই বেকারত্বের সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন ও উদ্যোগ দিয়ে বেকারত্ব দূর করতে চাই। পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতি আসবে, যখন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না।’ একজন সুস্থ শরীরের মানুষ বেকার থাকবে, এটা হতে পারে না। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু টাকা আয় করতে চাই। এটা হতাশাজনক। আমাদের সমাজের দায়বদ্ধতা কম। আমরা রোবটের মতো আচরণ করি।’ তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তোমরা ব্যবসার ধারণা নিয়ে আসো। আমরা তহবিল দিব।’
মূল আকর্ষণ কেরি কেনেডি: এবারের সামাজিক ব্যবসা দিবসের মূল আকর্ষণ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রবার্ট এফ কেনেডি সেন্টার ফর জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি। তিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
কেরি কেনেডি তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবদান উল্লেখ করে বলেন, ‘তাই ঢাকায় আসা আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল।’
বাংলাদেশের কথা সরাসরি উল্লেখ না করেই কেরি কেনেডি বলেন, ‘বিচারব্যবস্থা সমুন্নত রাখতে এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবসা-প্রক্রিয়া। গণতন্ত্রে নির্বাচনই মুখ্য, তবে তা সুষ্ঠু ও অবাধ হতে হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের সহযোগী হয়ে পড়েছে। যেখানে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্বাচন-প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। অনেক ভোটার আস্থা হারিয়ে ফেলছেন এই ব্যবস্থায়। তাঁরা ভোট থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন নিজেকে। এগুলো গণতন্ত্রের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।’
কেনেডির মতে, ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক হলো একক প্রতিষ্ঠান, যারা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এমন অবদান রেখেছে, যা বিগত ১০০ বছরে হয়নি। এখানে দুজনও পাওয়া যাবে না, যাঁরা এই মতের সঙ্গে দ্বিমত করবেন। তিনি বলেন, লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। তাঁদের সহায়তা করা উচিত। এই সামাজিক ব্যবসা কীভাবে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে, সেই বিবেচনা করা উচিত।
গ্রামীণ ব্যাংকই প্রথম সামাজিক ব্যবসা: উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে ড. ইউনূস বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকই ইতিহাসের প্রথম সামাজিক ব্যবসা। এ সময় তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের নয়জন নারী সদস্যকে মঞ্চে ডাকেন। মঞ্চে উপবিষ্ট হন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য মোসাম্মৎ তাহসিনা খাতুন, রেহানা আক্তার, সুলতানা, সাজেদা, সালেহা, পারুল, মেরিনা, শাহিদা ও মোমেলা। এ সময় ড. ইউনূস বলেন, তাঁরা (নারী সদস্যরা) গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
নারী সদস্যদের পক্ষে তাহসিনা খাতুন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘সরকার ব্যাংকটিকে সরকারীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। নতুন নির্বাচনপদ্ধতিতে ব্যাংকে রাজনীতি ঢুকে পড়বে। দলাদলি-হানাহানি হবে।’ তিনি দেশি-বিদেশি আগত অতিথিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের অধিকার রক্ষায় আপনারা সোচ্চার হোন, নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখুন।’
এ সময় তাঁদের আশ্বস্ত করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা সবাই আপনাদের সঙ্গে আছি। অধিকার আদায়ে লড়াই চলবে।’
দিনের একটি অধিবেশনে হাইতি, নেপাল, আলবেনিয়া, উগান্ডা থেকে আগত অতিথিরা তাঁদের নিজ দেশে কীভাবে সামাজিক ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন, সেই বিবরণ দেন। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও দুটি সামাজিক ব্যবসার মডেল তুলে ধরা হয়।
দিনের বিভিন্ন অধিবেশনে বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা, মিসরের রাষ্ট্রদূত মাহমুদ এজাজ, ফ্রান্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ড্যানোনের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ইমানুয়েল ফেবার প্রমুখ।
এবারের সামাজিক ব্যবসা দিবসের অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি এক হাজারের বেশি ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৩১টি দেশের ২৭৫ জন বিদেশি অতিথি এসেছেন। সামাজিক ব্যবসা দিবসের অনুষ্ঠানটি লাইভস্ট্রিমের মাধ্যমে ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, মেক্সিকোসহ বিশ্বের ৯০টি দেশে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে।
সমাপনী অনুষ্ঠান: সামাজিক ব্যবসা দিবসের দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে সমাপনী বক্তব্য দেন মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তিনি বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বের ১ শতাংশ মানুষের জীবন পরিবর্তন করতে চাই। আমরা যদি সামনের দিকে এক পা অগ্রসর হই, তাহলে হাজার মাইল পাড়ি দেওয়া কোনো সমস্যই নয়।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নতুন কোনো ধারণা যদি এখান থেকে আসে, তাহলে সেটাই আমাদের জন্য আশ্চর্য বীজ (মিরাকল সিড)। আর এই বীজ মানুষের জীবনে রূপান্তরিত হবে। এটাই আমাদের দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্দেশ্য।’
কাজের ক্ষেত্রে বয়সের সীমা থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করে ইউনূস বলেন, ‘অবসর বলে কোনো শব্দই থাকা উচিত না। রিটায়ারমেন্টকেই রিটায়ারমেন্টে পাঠানো উচিত।’
গ্রামীণ ব্যাংকের এই প্রতিষ্ঠাতা আরও বলেন, ‘আমি ভাগ্যবান। কারণ বাংলাদেশে অনেক অনেক সমস্যা। সমস্যা আছে বলেই তার সমাধানও অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ ও আনন্দময়। বিশ্বের যেসব দেশে কোনো সমস্যা নেই সেসব দেশ একদমই পানসে (বোরিং)।’
কর্মসংস্থানের বিষয়ে বলতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘কেউ যদি কোনো চাকরি না পায় তাহলে সমাজ তাকে ব্যর্থ মনে করে। কেন তাকে ব্যর্থ বলতে হবে। আমি নিজেই তো নিজের কর্মসংস্থান করতে পারি। চাকরি করতেই হবে, এটা হলো পুরোনো চিন্তাভাবনা। এসব পুরোনো চিন্তাভাবনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’
এর আগে সমাপনী অধিবেশনে তাইওয়ানে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশন ফর
শফিক আজিজি:
ইউনূস সোশাল বিজনেসের প্রতিষ্ঠাতা চোয়ান মিন ওয়াং বলেন, তাইওয়ানেও বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সেখানেও মজুরি কম। কিন্তু তরুণেরা বেশ পরিশ্রমী ও নতুন কাজে আগ্রহী। তাই তাইওয়ানে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সামাজিক ব্যবসা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভীন মাহমুদ বলেন, এ বছরই ট্রাস্টের আওতায় নবীন উদ্যোক্তা প্রকল্প শুরু করেছে। উদ্যোক্তাদের এরই মধ্যে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ছয়টি কর্ম-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি অধিবেশনের একজন করে বিশেষজ্ঞ এসব অধিবেশনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।