সেই মুলুকে প্রাণ সৃষ্টির প্রধান কারিগর জৈব অণুরা রয়েছে কি না, থাকলে তাদের নামধাম, চেহারা, চরিত্র কী কী বা কেমন, সে সবের হালহদিশ দেবে পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরির (জেপিএল) সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বানানো ডিটেক্টরই। যার নাম- ‘হাই রেজোলিউশন স্পেকট্রোমিটার ইন দ্য টেরা-হার্ৎজ ব্যান্ড’।

বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপার বরফে মোড়া পিঠের তলায় লুকিয়ে থাকা তরল জলের সুগভীর মহাসাগর

গৌতমের ‘আঁকা’ সেই ‘চোখ’ পা ছোঁয়াবে না ইউরোপায়। টপকাবে না বৃহস্পতির চৌকাঠও। ঢুকে পড়বে না বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে। সেই ডিটেক্টর থাকবে বৃহস্পতি আর ইউরোপার মাঝে থাকা কক্ষপথগুলিতে। বৃহস্পতির দিকে পিঠ ঠেকিয়ে নজর রাখবে ইউরোপার দিকে। আছে কি না প্রাণ সৃষ্টির জৈব অণু ইউরোপার বায়ুমণ্ডলে, তার ওপর কড়া নজর রাখবে। চোখে চোখে রাখবে ইউরোপা থেকে ছিটকে বেরনো, মহাকাশে ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়া জলকণাগুলিকে। তারই মধ্যে যে মিশে থাকতে পারে প্রাণ সৃষ্টির জৈব অণু! অজৈব অণুও। তবে জৈব অণুই তো জীবনের বীজ!

কেন গৌতমের বানানো ডিটেক্টরই বেছে নিল নাসা?

পিঠে ‘বোঝা’ চাপিয়ে মহাকাশযানকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ছুটতে হয় আর অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়। তাই তার পিঠের ‘বোঝা’র ভারটা যত কম হয়, ততই মঙ্গল।নবগ্রামের গৌতমের প্রথম কৃতিত্ব, তিনিই পেরেছেন ভিনগ্রহে প্রাণ খুঁজতে পাঠানো মহাকাশযানের পিঠের ‘বোঝা’ কমাতে। তাঁর বানানো ডিটেক্টরটির ওজন এক কিলোগ্রামেরও কম।

গৌতমের বানানো সেই ডিটেক্টর

গৌতমের দ্বিতীয় কৃতিত্ব, তাঁর বানানো ডিটেক্টরটি চালাতে বিদ্যুৎশক্তির খরচ প্রায় হয় না বললেই চলে। প্রয়োজন হয় মেরেকেটে ২০ ওয়াট বিদ্যুৎশক্তি। যা দিয়ে বড়জোর একটা এলইডি জ্বালানো যায়।এর আগে ধূমকেতু ‘৬৭/পি-চুরিয়ামোভ-গেরাশিমেঙ্কো’-এ নেমেছিল যে ‘রোসেটা’ মহাকাশযান, তাতেও ছিল একটি শক্তিশালী ডিটেক্টর। কিন্তু সেই ডিটেক্টরটি চালাতে প্রয়োজন হত অন্তত ৮০ থেকে ৯০ ওয়াট বিদ্যুৎশক্তির। যার ৪ ভাগের এক ভাগেরও কম বিদ্যুৎশক্তি খরচ করে চালানো যাবে গৌতমের বানানো ডিটেক্টর।

সৌরশক্তিতে না চললে মহাকাশে কোনও যন্ত্রকে দীর্ঘ দিন ধরে চালু রাখতে বেশি বিদ্যুৎশক্তি খরচ করা যায় না। কারণ, তা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। কিছুটা অসম্ভবও। কারণ, বাড়তি বিদ্যুৎশক্তির জন্য ব্যাটারির ওজন বাড়ানো হলে মহাকাশযানের পিঠের ‘বোঝা’টাও বেশি ভারী হয়ে যায় যে!তাই গৌতমের বানানো ডিটেক্টর ভিনগ্রহে প্রাণ খোঁজার দুরূহ কাজে নাসার দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমাতে পেরেছে।

নবগ্রাম থেকে পাসাডেনায় নাসার ল্যাবরেটরি

কোন্নগরের নবগ্রাম বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরনোর পর ঢোকেন কলকাতার মৌলানা আজাদ কলেজে। সেখান থেকে যান শিবপুর বিই কলেজের ইলেকট্রনিক্স বিভাগে। মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর অধীনে থাকা পুণের ‘জায়ান্ট মিটার ওয়েভ রেডিও টেলিস্কোপ’-এ কিছু দিন কাজের পর গৌতম চলে যান আমেরিকার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এমএস করে গৌতম পিএইচডি করেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (‘ক্যালটেক’) থেকে। ১৯৯৯ সালে যোগ দেন নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরিতে।

পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরিতে গৌতম (উপরে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়) সেই ২৪ জনের টিম

ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধানে ‘সাবমিলিমিটার ওয়েভ অ্যাডভান্সড টেকনোলজি’ (সোয়াট) নামে ২৪ জনের যে আন্তর্জাতিক গবেষকদলটি রয়েছে পাসাডেনায় নাসার ল্যাবরেটরিতে, গৌতমই তার টিম লিডার। এর আগে আর কোনও বাঙালি জেপিএলে এত বড় মাপের গবেষকদলের নেতৃত্ব দেননি।সেই গবেষকদলে রয়েছেন থিয়োডর রেক, সিসিল জং-কুইবেক, চুনসুপ লি, হোসে সাইল্‌স, মারিয়া আলন্সো-দেলপিনো ও আদ্রিয়ান ট্যাং-এর মতো বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। যাঁদের তিন জন গৌতমেরই ছাত্র।

নাসার কাছ থেকে কী ভাবে ওই যন্ত্র বানানোর অফার পেলেন গৌতম?

নাসা সূত্রের খবর, বৃহস্পতির দু’টি চাঁদ ‘ইউরোপা’ আর ‘গ্যানিমিদ’-এ জল তরল অবস্থায় রয়েছে কি না, থাকলে কতটা তা বুঝতে ২০০৯ সালে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল ‘হার্শেল স্পেস অবজারভেটরি’ (এইচএসও)। সেখানেই ছিল ‘হেটরোডাইন ইনস্ট্রুমেন্ট ফর দ্য ফার ইনফ্রারেড’ (সংক্ষেপে, ‘হাইফাই’) নামে একটি ডিটেক্টর। কিন্তু সেটা ছিল অনেক কম দূরত্বের অ্যাস্ট্রোফিজিক্স মিশন। সূর্য থেকে পৃথিবীর যে দূরত্ব আর অবস্থানকে বলা হয় ‘ল্যাগরাঞ্জে-ওয়ান (এল-ওয়ান) পয়েন্ট’, এইচএসও-র মধ্যে থাকা ‘হাইফাই’ ডিটেক্টরটি সেই দূরত্ব থেকেই নজর রেখেছিল ইউরোপা, গ্যানিমিদের উপর। প্রায় ৪ বছর।


যে ডিটেক্টর প্রথম জানিয়েছিল তরল জল রয়েছে ইউরোপায়, সেই ‘হাইফাই’

ঘটনা হল, মহাকাশে ওই দূরত্বে (‘এল-ওয়ান’) দীর্ঘ সময় ধরে চূড়ান্ত পর্যায়ে সক্রিয় রাখতে ডিটেক্টরটিকে অতি পরিবাহী বা সুপার কন্ডাক্টর করে তুলতে হয়। তা হলে তার সক্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। সেই ডিটেক্টর আরও সূক্ষ্ণ সিগন্যালগুলিকেও তখন ধরতে পারে। চিনতে, বুঝতে পারে। আর তার জন্যই প্রয়োজন হয় বিশেষ এক ধরনের জ্বালানির। যা আসলে তরল হিলিয়াম। কিন্তু মহাকাশযান ভারী হয়ে যাবে বলে বেশি পরিমাণে তরল হিলিয়াম পাঠানো যায়নি হার্শেল স্পেস অবজারভেটরিতে।

তরল হিলিয়ামের ভাঁড়ার ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে ২০১৩ সালের পর ‘হাইফাই’ ডিটেক্টরটি অচল হয়ে পড়ে মহাকাশে। তবে ওই অল্প সময়ের মধ্যেই ‘হাইফাই’-এর তোলা ছবি জোরালো ইঙ্গিত দিয়েছিল, তরল জলের বহু মহাসাগর রয়েছে ইউরোপার বরফে মোড়া পিঠের ১৫ থেকে ১০০ কিলোমিটার গভীরতায়। সেখানে প্রাণ বা প্রাণ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় জৈব অণুর হদিশ পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই জোরালো।

এর পরেই নাসা আরও শক্তিশালী ডিটেক্টর বানানোর চিন্তাভাবনা শুরু করে। যে ডিটেক্টর মহাকাশে আরও দূরে পাঠানো যাবে। অ্যাস্ট্রোফিজিক্স মিশনের চেয়েও যে অনেক বেশি দূরত্বে পাড়ি জমাতে হয় ভিনগ্রহে প্রাণ সন্ধানের অভিযান- ‘আউটার প্ল্যানেট মিশন’-এ।

বৃহস্পতির জলে ভরা চাঁদ-

নাসা চেয়েছিল, এমন ডিটেক্টর বানানো হোক, যা মহাকাশেও কাজ করতে পারে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায়। তা হলে মহাকাশে তাকে ঠান্ডা রাখার জন্য তরল হিলিয়ামের মতো ‘কুল্যান্ট’ পাঠানোর আর প্রয়োজন হবে না। এমন ডিটেক্টর বানানোরই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গৌতমকে।পাসাডেনা থেকে গৌতম আনন্দবাজারকে বলছেন, ‘‘২০১৪ সালে নাসা আমাকে এই দায়িত্ব দেয়। গোটা প্রজেক্টের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে। তিন বছরের গবেষণার পর ২০১৭-র শেষাশেষি সেই ডিটেক্টর বানানো সম্ভব হয়েছে।’’নাসা সূত্রের খবর, গৌতমের বানানো ডিটেক্টরটি ইউরোপার উদ্দেশে রওনা হবে ২০২০/’২২ সালে। তা বৃহস্পতি আর ইউরোপার মাঝের কক্ষপথে প্রথম পৌঁছবে ২০২৭/’২৯ সালে।

কী ভাবে ইউরোপায় প্রাণ খুঁজবে গৌতমের বানানো ডিটেক্টরটি? গৌতম বলছেন, ‘হাইফাই’ ডিটেক্টরের পাঠানো ছবি, তথ্যাদি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গবেষণা জানিয়েছে, ইউরোপার পিঠের পুরু বরফের চাদরটা একেবারে নিশ্ছিদ্র নয়। তাতে বহু ফাটল (ক্র্যাক) রয়েছে। ইউরোপার গোটা পিঠেই তা ছড়ানো। সেই ফাটলের পথ ধরেই বরফের চাদরের তলায় লুকিয়ে থাকা সাগর, মহাসাগরের জল উঠে আসে ইউরোপার বরফে মোড়া পিঠে। কিন্তু সেই তরল অবস্থায় থাকা জলের কণাগুলি বরফ হয়ে যাওয়ার আগেই বৃহস্পতি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা সুতীব্র বিকিরণের গনগনে তাপে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। মিশে যায়, ভেসে থাকে ইউরোপার বায়ুমণ্ডলের একেবারে উপরের স্তরে।

 

ইতিমধ্যেই ‘হাইফাই’ ডিটেক্টর ইঙ্গিত দিয়েছে, ইউরোপার বায়ুমণ্ডলে মিশে ও ভেসে থাকা জলকণায় প্রাণ সৃষ্টির জৈব অণুর হদিশ মেলার সম্ভাবনা যথেষ্টই জোরালো।এখানেই শেষ নয়। খুব বড় আর খুব ভারী গ্রহ বলে বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্রও প্রচন্ড শক্তিশালী। সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের জোরালো টানে ইউরোপার বায়ুমণ্ডলে মিশে ও ভেসে থাকা জলকণা আর তাতে থাকা সম্ভাব্য জৈব ও অজৈব অণুরা নিয়মিত ভাবে ছিটকে বেরচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে। ফুলঝুরির ফুলকির মতো। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘স্পাটারিং’।

গৌতমের বানানো ডিটেক্টর মহাকাশে ছিটকে, ছড়িয়ে পড়া ওই ‘ফুলকি’গুলির উপর কড়া নজর রাখবে। তাতে প্রাণ সৃষ্টির জৈব অণু মিশে রয়েছে কি না, তা জানতে। আর তা দেখা হবে ৫৫৭ গিগা হার্ৎজ থেকে ১.২ গিগা হার্ৎজ পর্যন্ত, আলোকতরঙ্গের কম্পাঙ্কের একটি বিশেষ ব্যান্ডে। এই ব্যান্ডে এর আগে কখনও ভিনগ্রহে প্রাণের ‘চিহ্ন’ খোঁজেনি নাসা।

বৃহস্পতির মুলুকে প্রাণ-

যদি না-ই মেলে প্রাণের অণু বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপায়, তা হলেও তেমন ক্ষতি নেই। কারণ, যে প্রযুক্তিতে ওই ডিটেক্টর বানিয়েছেন গৌতম, তা এতটাই অভিনব যে, নাসা ইতিমধ্যেই শুক্র, মঙ্গল ও শনি গ্রহেও ওই ডিটেক্টর পাঠিয়ে প্রাণ সৃষ্টির জৈব অণু খোঁজার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।গৌতমের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি আমাদের মোবাইল ফোন, আইফোনেও ঘটিয়ে দেবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ডেটার গতি বাড়িয়ে দেবে কল্পনাতীত ভাবে। ফাইভ-জি, সিস্ক-জি, সেভেন-জি স্পেকট্রামের দরজাটাও আমজনতার সামনে খুলে দেবে, জানাচ্ছে নাসা।

  তথ্যসূত্র: জার্নাল ‘আইইইই-কমিউনিকেশন্স’ গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ

কলকাতা সহ বিশ্বের বড় বড় শহরগুলির রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম কমাতে যেমন ফ্লাইওভার, মাস্টিস্টোরিড বা বহুতল ফ্লাইওভার বানানোর কর্মযজ্ঞ চলছে, এটাও অনেকটা সেই ব্যাপার। ফাইভ-জি, সিস্ক-জি, সেভেন-জি স্পেকট্রামের সুবিধাটা শুধুই বহুতল ফ্লাইওভারের সুবিধার মতো নয়, তা মাল্টিলেন (বহু পথ) ফ্লাইওভারের সুবিধাও দেবে আমজনতাকে। সামনে ডেটার ‘জ্যাম’ সে ক্ষেত্রে কমে যাবে বলে ডেটা আরও দ্রুত গতিতে ছুটবে। বাড়বে ই-মেলের গতিও।সফল বিজ্ঞানী হতে গেলে অনেক দূর দেখতে জানতে হয়, শিল্পীর রোম্যান্টিকতা থাকতে হয়, প্রমাণ করলেন কোন্নগরের গৌতম। ছবি ও অ্যানিমেশন ভিডিও সৌজন্যে: নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি, পাসাডেনা