বিশ্বব্যাংকের পদ্মা ষড়যন্ত্র-গোমর ফাঁস
বিশেষ প্রতিনিধি : বিশ্বব্যাংকের পদ্মা ষড়যন্ত্র গোমর ফাঁস করলেন এবার আনিসুল হক। বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের পেছনের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ করলেন আইনমন্ত্রী। মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এই রহস্য তুলে ধরেন তিনি।
২০১২ সালের পদ্মা সেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের মামলায় প্রধান আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অ্যাডভোকেট আনিসুল হক (বর্তমানে আইনমন্ত্রী) পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের স্বাক্ষরকারী একটি অংশ। তাই তাদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়া যাবেনা। তবে যারা ক্ষতিগ্রস্থ তারা চাইলে এর বিরুদ্ধে আইনত পদক্ষেপ নিতে পারে। তাদের এ বিষয়ে আইনত পরামর্শ নেয়া উচিত।
২০১২ পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে মামলা শুরু ইতিহাস তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, একটা পত্রিকায় একটা খবর আসলো, বিশ্বব্যাংকে এমন কথা উঠেছে যে পদ্মা সেতু সুপারভিশন কন্ট্রাক্টের ব্যাপারে একটা দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং দুর্নীতি হচ্ছে। তখন দুদক তার নিয়ম অনুসারে এই খবরের ওপর একটা অনুসন্ধান করতে শুরু করল।
তিনি বলেন, দুদকের অনুসন্ধানের সময় বিশ্বব্যাংক বলল, আমাদের কাছেও তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। আমরা সেই তথ্য দেবো। এই নিয়ে তোমাদেরকে(দুদক)একটি মামলা করতে হবে। বলা হলো, এই দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে যারা জড়িত তারা হচ্ছেন- তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন, যোগাযোগ সচিব, অন্য যারা এই মন্ত্রণালয়ে আছেন তারা এবং যারা এই কন্ট্রাক্ট নেয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
তিনি আরো বলেন, তখন একটা পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হলো, দুদক একা নয়। এখানে বিশ্বব্যাংক তাদের লোক দিয়ে দুদকের মাধ্যমে অনুসন্ধান করবে। আমরা তখন দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বসলাম। সেখানে পরিষ্কারভাবে আমরা বলে দিলাম, আমাদের দেশের আইনে এমন কোনো শর্ত বা নিয়ম নেই যেটা দুদকের করার কথা সেটা অন্য কোনো বিদেশী সংস্থা অনুসন্ধান করবে। এরকম যদি হয় তবে মামলাই করা যাবে না। কারণ মামলা টিকবে না।
এটা যখন বললাম তখন তারা বললেন, এটা যদি না হয় তবে আমরা (বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ) ঋণ দেবো না। দুদকের চেয়ারম্যান, দুদকের পরবর্তী চেয়ারম্যান বদিউজ্জামানের ও কমিশনার সাহাবুদ্দিন আহমেদ চুপ্পুর উপস্থিতিতে সেই মিটিংয়ে তখন আমি বললাম, বাংলাদেশ হলো একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশ একটি স্বার্বভৌম দেশ। আমরা আমাদের স্বাধীনতা কারো হাতে তুলে দিতে রাজি না। কারণ এ বিষয়টা যখন বিশ্বব্যাংকের হাতে তুলে দেব তখন তার মানে দাঁড়ায় আমাদের স্বাধীনতা তাদের হাতে তুলে দেবো। আমরা ১.২ বিলিয়নের জন্য বা এটা যদি ১.২ ট্রিলিয়ন ইনটু ইনফিনিটি করা হয় তারপরেও আমরা এই ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা পেয়েছি সেই স্বাধীনতা কারো হাতে তুলে দেবো না। তারপরেই কিন্তু টাকা যে দেয়া হবেনা- সেই ঘোষণা তারা দিয়ে দিলেন।
আনিসুল হক জানান, তারা (বিশ্বব্যাংক) আরো বললেন, যদি আমরা তদন্ত করতে না পারি তাহলে আমাদের একটা তদন্ত টিম অন্তত দুদকের তদন্ত টিমের সঙ্গে থাকবে এবং তারা সেটা তদন্ত করবে। এখানেও আমি বললাম, আইনে সেটাও বলা নেই। আমরা সেটা দিতে পারিনা। আমার এসব কথার সকল নথি এখনও আমার কাছে লিখিত রয়েছে।
আমরা বললাম, আপনারা যেহেতু অভিযোগকারী যেহেতু একটা জিনিস হতে পারে। আপনাদের তরফ থেকে দুদকের সঙ্গে তদ্বিরকারী রাখতে পারেন। ফলে এই মামলায় আমরা কতটুকু উন্নতি করছি, অগ্রসর হচ্ছি তার প্রতিবেদন তারা আপনাদেরকে দিতে পারবে। সেই তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। তারা এটা মানলেন এবং বললেন তারা একটি টিম অব এক্সপার্টস পাঠাবেন। এরপর তারা টিম অব এক্সপার্টসদের নাম দিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের চিফ প্রসিকিউটর ওকামপো, হংকং এর এ্যান্টি করাপশন কমিশনের একজন মেম্বার এবং স্কার্ডিয়ানের একজন তদন্তকারী। তারা সম্ভবত ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২/১৩ তারিখ আমাদের দেশে এসেছিলেন। এসময় তাদের সঙ্গে আমরা মিটিং করি।
মিটিংয়ে তারা কি বলেছিল তা আমার মনে আছে। মিটিং এ উনারা প্রথমেই বলেছেন, আবুল হোসেনকে আসামি করতে হবে।আমরা বললাম তথ্য-উপাত্ত যদি না পাই তাহলে আমরা কীভাবে একজনকে আসামি করব? তখন তারা মামলার এফআইআর-এ আবুল হোসেনের নাম দিতে বললেন। তাদের একজন এই পর্যন্তও বললেন, এফআইআর-এ তার নাম দিয়ে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলেই সব বেরিয়ে যাবে।
আমরা তখন দৃঢভাবে বললাম, না। তা হতে পারে না। এরপর মিটিংয়ে বিশ্বব্যাংকের দুই প্রতিনিধির উদ্দেশ্যে বললাম, দুদককে আপনারা যেই সব কাগজপত্র, দলিলপত্র দিয়েছেন তার বাইরে আপনাদের কাছে আর কোনো কাগজপত্র আছে কি? তারা বললেন, না।
আমি তখন ওকামপোকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটাই যদি দলিলপত্র হয়ে থাকে তাহলে এখানেতো মন্ত্রী আবুল হোসেনর যে তথ্য দেখছি তা হচ্ছে তার সঙ্গে ওই কোম্পানীর চারজন গিয়ে তার সাথে দেখা করেছে। এইটুকু ছাড়া তার আর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এখানে কোনো তথ্য নেই যে, তাকে এত টাকা দেয়া হবে বা টাকা দেবার লেনদেনের বিষয়ে কোনো আলাপ–আলোচনা হয়েছে, সে তথ্যও নেই। তাহলে আমরা তাকে আসামি করব কীভাবে?
আমরা যখন এই কথা বললাম তখন তাদের একজন রেগে গিয়ে চুপ্পু সাহেবকে বললেন, আপনি কি আবুল হোসেনকে চেনেন? তিনি কি আপনার আত্মীয়? আমি বাধা দিলাম। বললাম, এভাবে আপনি উনার সঙ্গে কথা বলছেন কেন ? তখন তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি তাকে চেনেন ?
আমি বললাম, নিশ্চই আমি তাকে চিনি। তিনি এই দেশের মন্ত্রী, তাকে চিনব না কেন। কিন্তু আপনি যদি বলেন আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তাহলে আমি বলব, তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই। আপনারা এসব কথা বলবেন না। বরং আপনারা কাগজে তথ্য থাকলে বলুন আমরা তাকে আসামি বানাব।
এরপর ওনারা বলেছেন, কোনো অপরাধ করার ষড়যন্ত্রের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। তখন আমি স্পষ্ট বলেছি যে, এ বিধান আছে। কোনো অপরাধের ষড়যন্ত্র করাও অপরাধ এবং সেই ষড়যন্ত্রের শাস্তি অপরাধের মতই সমান। এটা আইনে আছে। তারা তখন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে গেলেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, এই ওকাম্পোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং সেই দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তার কিছুদিন পরে আমরা জানতে পারলাম, ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ৮ থেকে ১৯ তারিখের মধ্যে কানাডার একটি কোর্টে এসএমসি লেভেলিং কোম্পানীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ ছিলো তার তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হবে এবং তাদের বিচার হবে। তো সেখানে বিচারের নিয়ম হলো পূর্ববর্তী শুনানি হওয়ার মাধ্যমে মামলাটি আদৌ ট্রায়ালে যাবে কিনা তার ব্যবস্থা করা। সেই শুনানি হবে এপ্রিল মাসের ৮ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত। তখন দেশে ভিসা পাওয়ার যে নিয়ম ছিলো, সে অনুসারে আমাদের যাওয়ার সময় ছিলোনা। সেই কারণে ঠিক সেই সময় সেখানে দুদকের কোনো প্রতিনিধি যাওয়ার সুযোগ পায়নি।
তিনি বলেন, আমি এই মামলার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য ২০১৩ সালের মে মাসের ২৯ তারিখ টরন্টোতে যাই। আমি টরন্টোতে যাওয়ার আগে ক্যানাডার হাইকমিশনার থেকে একটি বার্তা পাই। সেখানে তিনি পরিষ্কারভাবে আমাকে বলেছিলেন, যে আমি টরন্টোতে গেলে কানাডার কোনো অফিসার আমার সাথে কথা বলবেনা, দেখা করবেনা, ফোন ধরবেনা এবং কোনো সহযোগিতা করবে না। তখন আমি ফোন করে তাকে জানাই আমিতো টিকেট কেটে ফেলেছি। আজকে আমাকে যেতেই হবে।
আমি কানাডায় গেলাম। যাওয়ার পরে যেটা প্রথমেই জানতে পারলাম সেটা হলো, আমরা(দুদক) ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর একটি এফআইআর করেছিলাম। সে এফআইআর-এ যাদেরকে আসামি করা হয়েছিলো তাদের মধ্যে একজন ব্যবসায়ী ছিলো। আমেরিকার প্রবাসী সেই ব্যবসায়ীকে বিশ্বব্যাংক এখান থেকে গোপনে আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছে। নিয়ে যাওয়ার পর তাকে বলেছে সব দোষ থেকে তাকে মুক্ত করবে যদি সে রাজসাক্ষী হয় এবং সেই হিসাবে কানাডার রয়েল মাউন্টেন পুলিশ ২৬/২৭ ফেব্রুয়ারি তার একটি জবানবন্দি গ্রহণ করে। সেই জবানবন্দির পরিপ্রেক্ষিতে প্রি হেয়ারিং হয় এবং তারও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, জবানবন্দির সার্টিফাইড কপি পাওয়ার জন্য আমাদের একটি দরখাস্ত করা ছিলো। আমাকে তখনকার কানাডিয়ান হাইকমিশনার যা বলেছিলো তা সত্য। কেউ আমার সঙ্গে তখন সহযোগিতা বা কথা বলতে রাজি হয়নি।
তবে আজকে আমি বলতে পারি, দুদকের কাছে সেই প্রিলিমিনারি হিয়ারিংয়ে যারা যারা সাক্ষ্য দিয়েছে তার সাক্ষ্য-তথ্য রয়েছে। সেই সাক্ষীর সাক্ষ্য আমি পড়েছি। এমনকি যিনি রাজসাক্ষী হয়েছিলেন তিনি এই যাদের নাম বললাম (যাদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছিলো) তাদের বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। এমনকি এখানে যে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে সেটিও প্রমাণ করতে পারেননি। এরপরেই নতুন করে কিছু আসামি যুক্ত করার চেষ্টা চলেছে। তারপর দেশে ফিরে এসে আমি কোনো মন্তব্য করিনি। কারণ, এক. দুদকের এফআইআর করার কারণে মামলার তদন্ত চলছিল। দুই, কানাডার সুপিরিয়র কোর্ট বিষয়টি পাবলিসিটি ব্যান্ডের আদেশ দিয়েছিলো। অর্থাৎ এই মামলায় যে সাক্ষ্য-প্রমাণ দেয়া হয়েছিলো তা যেন সবসময়ই ওপেন কোর্ট এবং পাবলিক হিয়ারিং না হয় এবং পাবলিকেশন করা না হয়। মানে পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে খবর উঠানো যাবেনা। আমরা সেই সময় তদন্তের স্বার্থে চুপ ছিলাম। আজকে সেইজন্যই এত কথা বলছি।
আজকে রায় যেটা হলো তাতে বাংলাদেশের মর্যাদা অনেক বেড়ে গেছে। আমরা যে সহিষ্ণু জাতি এটা প্রমাণ পেয়েছে। আমরা যে কারো কাছে মাথা নত করিনা সেটা আমাদের শিখিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ, তিনি সেদিন বলেছিলেন, এই যে দুর্নীতি হয়েছিল সেটা তোমরা (বিশ্বব্যাংক) প্রমাণ করো। তোমরা যখন পদ্মা সেতুর টাকা দেবেনা সেহেতু আমরা নিজের টাকায় সেতু করব। আজকে পদ্মা সেতু নিজেদের টাকায় হচ্ছে। এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।