বিবেকহীন কর্তার কবলে বুয়ার মুত্যুতে লংকাকান্ড বনশ্রীতে
বিশেষ প্রতিনিধি : রাজধানীর খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ বনশ্রীতে লাইলী বেগম মরিয়ম (৩৫) নামে এক ছুটা বুয়াকে বেতন না দিয়ে দারোয়ান দিয়ে মারধরে মৃত্যু নিয়ে লংকাকান্ড ঘটেছে বনশ্রীতে। এনিয়ে দিনভর উত্তপ্ত ছিল ওই এলাকা। এদিকে গৃহকর্মীকে হত্যার অভিযোগ এনে বস্তিবাসী বাড়িটি ঘেরাও করে ভাংচুর বিক্ষোভ করে একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, বিক্ষোভকারীরা সাততলা ওই বাড়ির জানালা-দরজার কাঁচ ভাংচুর করে বাড়ির পাশে রাখা একটি প্রাইভেট কার জ্বালিয়ে দিয়েছে। বস্তিবাসীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম, এসআই আফজাল হোসেন ও এসআই মঞ্জুর রহমানসহ অন্তত ১০ পুলিশ আহত হয়েছেন।
বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে অন্তত ৫০ রাউন্ড টিয়ার শেল ছুঁড়েছে পুলিশ। শুক্রবার (৪ আগস্ট) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বনশ্রীর বি-ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়ি ঘিরে এসব ঘটনা ঘটে। ওই বাড়ির মালিক মাইনুদ্দীন মুন্সী সাবেক ভ্যাট কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বর্তমানে বেসরকারি নাসির গ্রুপে কর্মরত। পুলিশ গৃহকর্তা ও বাড়ির ম্যানেজার টিপুকে আটক করেছে।
খিলগাঁও থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম বলেন, লাইলী বেগম খিলগাঁওয়ের ভূইয়াপাড়ার হিন্দুপাড়া বস্তিতে থাকতেন। তিনি বনশ্রীর মাইনুদ্দীন মুন্সীর বাড়িতে ছুটা বুয়া হিসাবে কাজ করতেন। প্রতিদিন সকালে তার বাসায় গিয়ে রান্না ও ঘর পরিষ্কার করতেন।
শুক্রবার (৪ আগস্ট) সকাল ১০ টার দিকে গৃহকর্তা পুলিশকে ফোন করে জানায় যে, তার বাসার ছুটা বুয়া বাড়ির নিচতলায় দারোয়ানের কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবর পেয়ে পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। পুলিশ গিয়ে দেখতে পায় ওই বাড়ির সামনে তখন পর্যন্ত শতাধিক বস্তিবাসী ঘেরাও করে রেখেছে। তারা পুলিশকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।
এদিকে, হিন্দুপাড়া বস্তির বাসিন্দা আফরোজা বেগম জানান, লাইলীর স্বামী নজরুল ইসলাম ভারতের কারাগারে বন্দী। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার কাশীপুর গ্রামে লাইলীর বাড়ি। মরিয়ম (৫) ও আতিক (২) নামে লাইলীর দুইটি সন্তান রয়েছে। এদের মধ্যে একটি সন্তান মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী।
সবমিলিয়ে লাইলী ছুটা বুয়ার কাজ করে যা পেতেন তা দিয়ে সংসার চলত। এরই মধ্যে লাইলীর তিন মাসের বেতন বকেয়া পড়ে যায়। বকেয়া বেতনের দাবিতে শুক্রবার (৪ আগস্ট) লাইলী সকাল ৯ টার দিকে ওই বাড়িতে যান। সাততলা বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে গৃহকর্তা থাকেন।
বেতন চাইলে গৃহকর্তা তাকে গালমন্দ করে বাসা থেকে বের করে দেন। বাড়ির নীচ তলায় আসার পর দারোয়ান দিয়ে তাকে চড়-থাপ্পড় মারানো হয়। এতে সেখানেই লাইলী অচেতন হয়ে পড়ে যান। পড়ে বাড়ি থেকে একটি হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠানো হয়। অ্যাম্বুলেন্স বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই লাইলী না ফেরার দেশে চলে যায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বনশ্রীর আশেপাশের বিভিন্ন বস্তি থেকে শত শত মানুষ জড়ো হতে থাকে ওই বাড়ির সামনে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল ১০ টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাইলীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা জানায়, আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়।
লাইলীর মৃত্যুর খবরে বস্তিবাসীরা ওই বাড়ির সামনে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা বাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। থেমে থেমে প্রায় তিন ঘন্টা ধরে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ফলে ওই বাড়ির জানালা-দরজার বেশিরভাগ কাঁচ ভেঙ্গে গেছে। বেলা ১২ টার দিকে বস্তিবাসীরা বাড়ির প্রবেশ দরজা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে বস্তিবাসীদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। বস্তিবাসীরাও পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
খবর পেয়ে সেখানে মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে ৩ প্লাটুন পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এডিসি সাইফুল ইসলাম বস্তিবাসীদের শান্ত করার চেস্টা করলে তার ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বেলা ৩ টার দিকে বস্তিবাসীরা লোহার রড ও শাবল দিয়ে বাড়ির চারদিক হামলা চালায়। এক পর্যায়ে প্রবেশগেটের ছোট গেটটি ভেঙ্গে যায়।
সাততলা ওই বাড়ির নীচতলায় একটি অংশ গাড়ির পার্কিং। চতুর্থতলা বাদে বাকি তলায় দুইটি করে পরিবার ভাড়া থাকেন। এদের মধ্যে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ভাড়াটিয়া বাসিন্দা বৃদ্ধ মনিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী জমিলা খাতুন বলেন, ‘আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম গেটে ভেঙ্গে শত শত মানুষ বাড়িতে ঢুকে আগুন জ্বালিয়ে দিবে। আল্লাহ আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কীভাবে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আতংকে ছিলাম তা বলা সম্ভব নয়।’
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রন কক্ষে কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, বিকাল সোয়া ৪ টার দিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা ওই বাড়ির পাশে রাখা একটি প্রাইভেট কারে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ইউনিট গিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেললেও প্রাইভেট কারটি সম্পূর্ণরুপে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। প্রাইভেট কারটির মালিক ছিলেন মাইনুদ্দীন মুন্সী। পরে বিক্ষোভকারীরা সেখানে টেলিফোনের ক্যাবল প্যাঁচানো কাঠের চাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়।
অপর দিকে, দুপুরেই পুলিশ ওই বাড়ি থেকে গৃহকর্তা ও বাড়ির ম্যানেজারকে আটক করে খিলগাঁও থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের কাছে গৃহকর্তা মাইন্দ্দুীন মুন্সী বলেন, লাইলী বাসায় প্রতিদিন সকালে কাজ করতে আসে। বাসায় এসে নীচতলার একটি রুমের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ডাকাডাকি করলেও দরজা না খুললে বাড়ির ম্যানেজার টিপুকে তিনি ডেকে পাঠান।
তারা ব্যর্থ হলে পরে দরজার খিল ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে দেখতে পান যে লাইলী সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলছে। ওই অবস্থায় ওড়না কেটে তাকে নামানো হয়। তিনি নিজেই অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকরা জানান যে লাইলী মারা গেছে।
দক্ষিণ বনশ্রী বাড়ির মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হক বলেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে, গৃহকর্তা দারোয়ানকে দিয়ে লাইলীকে চড়-থাপ্পড় মারেন। এতে লাইলী ঘটনাস্থলে অচেতন হয়ে পড়েন। হয়তো এভাবেই তিনি মারা যেতে পারেন। তবে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করার বিষয়ে তিনি কোন বক্তব্য পাননি।