‘বিচার ব্যবস্থার নৈরাজ্য অশুভ শক্তিসমূহকে সাহস জোগাচ্ছে’
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আমরা সবাই যে দারুণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, তার মূলেও রয়েছে বিচারিক অব্যবস্থা। বিচার ব্যবস্থার শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতা রক্ষায় আমাদের ব্যর্থতা আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও বিবেকের দাবির সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করে চলছে।
মানুষের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালনে সরকারের অবহেলা এতদিনে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশে না আছে জীবনের নিশ্চয়তা, না আছে বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা। আমাদের বেঁচে থাকার শাসনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার রাজনৈতিক দায়িত্বের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও পুলিশি দায়িত্বের ভেতর যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে তা আমাদের বুঝতে হবে।
রাইট টু লাইফ বা জীবনে বেঁচে থাকার অধিকার শাসনতন্ত্র প্রদত্ত অধিকার। আমাদের শাসনতন্ত্রে রয়েছে, কারও জীবন বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ ব্যতীত নেয়া যাবে না। এর অর্থ এই যে, আইনি পদ্ধতি এড়িয়ে কেউ যাতে কারও জীবন নিতে না পারে, হত্যা করতে না পারে, তা রাজনৈতিক সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে রাজনৈতিকভাবে।
দেশে এখন হত্যার পর হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। গত সোমবার একদিনেই পাঁচজনকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। হত্যাকারীদের কাছে সরকারের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। সরকার ব্যস্ত আছে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের বিচার করার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য।
ক্ষমতাসীন নেতারা অপরাধ দমনের সব দায়িত্ব পুলিশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেশব্যাপী হত্যা, গুম ও ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধের দৌরাত্ম্য না পারছে থামাতে, না পারছে নিজেদের দায়িত্ব সচেতন করে তুলতে। পুলিশ এবং পুলিশি শক্তিই যেন দেশ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকদিন থেকে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি আমাদের ওপর চেপে বসেছে। জীবন রক্ষার দায়িত্ব যে শুধু আমলাতান্ত্রিক পুলিশি ব্যবস্থার নয় তাও সরকারকে বুঝতে দেয়া হচ্ছে না। হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখীন করা পুলিশের দায়িত্ব, এ দায়িত্বের সঙ্গে জীবন রক্ষার দায়িত্বকে গুলিয়ে ফেলে দুটি বিষয়কে এক করে দেখার সুযোগ নেই। মানুষ হত্যা সাধারণ অপরাধ নয়। মানুষের জীবন রক্ষার দায়িত্ব সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব- শুধু পুলিশি ব্যাপার নয়। কারা খুনখারাবির জন্য দায়ী তার চেয়ে অনেক বেশি দুশ্চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে জীবন হারানোর বিষয়টি। জীবন রক্ষার দাবি না করে সরকারের কাছে অপরাধীদের জন্য বিচার চাওয়া অর্থহীন।
অপরদিকে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় অপরাধমূলক মামলাগুলোর শুরু ও পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন- যা স্বাধীন ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বিচার প্রক্রিয়া সরকারের কুক্ষিগত রাখার অর্থ হল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করা। কার বিচার হবে কার হবে না তা নির্ভর করছে সরকার নিয়ন্ত্রিত পুলিশের ওপর। অপরাধ দমনে শুধু পুলিশের ওপর সব দায়িত্ব দিয়ে সরকারের ব্যর্থতা এড়ানো যাবে না।
আমাদের বিচার বিভাগ যেমন স্বাধীন করা হয়েছে, ঠিক তার অংশ হিসেবে বিচারিক কার্যক্রমকেও হতে হবে স্বাধীন এবং এটাই আমাদের শাসনতন্ত্রের দাবি। এটি আইনের শাসনের মূল কথা। এজন্য বিচার প্রক্রিয়াকে, বিশেষ করে অপরাধসংক্রান্ত মামলার কার্যক্রমে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রশ্ন ওঠে না।
সুবিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কতটা ক্ষতিকর হয়েছে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে অপরাধসংক্রান্ত মামলার রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ দেখে। মানুষের জীবন রক্ষার প্রশ্নে খুনিদের ধরার ব্যাপারে চরম অযোগ্যতা দেখালেও সরকার চাইলে অন্য যে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দিয়ে জেলে পুরতে পারে। কোর্টের বিচারে কী হবে তা নিয়ে ভাবতে হয় না। আইনের শাসনের কথা হল, আদালতে মামলা করার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ প্রসিকিউশন বিভাগের বিবেচনার বিষয় হবে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় সরকার নয়, ফৌজদারি মামলা শুরু করে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই তা পরিচালনা করা হয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাই সরকার সর্বতোভাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে।
মানবাধিকার রক্ষা কিংবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্নে আমাদের দেশের সরকারি মানবাধিকার কমিশন কিংবা বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলো কোনো উচ্চবাচ্য করে না। মানবাধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করার আবেদন তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টিকে তারা আসলে সরকারের বদান্যতার দৃষ্টান্ত মনে করেন। ফৌজদারি মামলার বিচার প্রক্রিয়াকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিও তারা তোলেন না। এর অনিবার্য ফল হল, মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সহজেই ঘটে চলেছে। তাদেরও অজানা থাকার কথা নয় যে, সুবিচার নিশ্চিত করার স্বাধীনতা না থাকলে মানবাধিকার লংঘন হতেই থাকে।
গোটা ফৌজদারি বিচারিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। পুলিশ সরকারি পুলিশ, আইনজীবী সরকারি আইনজীবী এবং সরকার বদলালে তাদেরও বদল হচ্ছে নতুন সরকারের আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য।স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষেত্রে কমিশনের নিজস্ব আইনজীবী আছেন, যাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।
কিন্তু দেশব্যাপী ফৌজদারি মামলা স্বাধীনভাবে পরিচালনার ব্যাপারে এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা হচ্ছে না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র অ্যাটর্নি সার্ভিস আইনের ড্রাফট তৈরি করেছিল। বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আইনটি পাস করতে পারে। তবে তেমন কোনো সদিচ্ছা যে তাদের নেই তা পরিষ্কার। সরকার ব্যস্ত আছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একেবারেই না রাখার জন্য।
বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার প্রশ্ন বাদ দিলেও, শাসনতান্ত্রিকভাবে সরকার আইনের শাসনের অধীনে থাকার কারণে বিচারিক প্রক্রিয়ার দায়িত্ব নিজ হাতে রাখতে পারে না। বর্তমান ব্যবস্থায় যেহেতু মামলা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের হাতে, তাই যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের পক্ষে আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করা সহজ হয়েছে।
আইনের শাসনের অধীনে কার বিচার হবে এবং কার বিচার হবে না সেটা সরকারের পক্ষে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ থাকতে পারে না। স্বাধীন প্রসিকিউশন ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। সাক্ষ্য-প্রমাণের তোয়াক্কা না করে সরকার চাইলে পুলিশ যে কাউকে জড়িয়ে মামলা দেবে, পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে তাকে শায়েস্তা করা হবে- এটি আইনের শাসনের কথা নয়।
যখন কেউ ফৌজদারি মামলায় বিচারের সম্মুখীন হন, তখন তার মৌলিক অধিকারের দরকার হয় সবচেয়ে বেশি। একজন অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নিতে পারে। এমনকি রাষ্ট্রপক্ষের চাপাচাপিতে তাকে জামিন না দিয়ে আটক রাখা হতে পারে। এভাবে কোনো মৌলিক অধিকারই তার উপকারে আসে না। এমনকি তার অবর্তমানে আয়ের উৎস থেকে বঞ্চিত হয়ে পরিবার-পরিজন অনাহারের ঝুঁকিতেও পড়তে পারে। আমাদের বিচার প্রক্রিয়ায় মানবিক দিকটি ভীষণভাবে অবহেলিত হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেই সে অস্তিত্বহীন, অসহায় হয়ে পড়ে। তাকে অপরাধী হিসেবে দেখা হয়। অপরাধজনিত মামলায় পুলিশকে দায়িত্বশীল ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেয়া হলে তাদের অসৎ হতেই সাহায্য করা হয়।
এভাবে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশের কাছে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলা হয়। অথচ আমাদের শাসনতন্ত্রেই বলা আছে, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। তিনি সবসময় আইনজীবীর সাহায্য নিতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত হল তাকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে নয়, জেলগেটে আইনজীবীর উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে।
নিম্ন আদালতসমূহকে চাপের মুখে সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্তের কথা ভুলে যেতে হচ্ছে। এ ধরনের ব্যত্যয়ের ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টও তেমন দৃঢ় অবস্থান নিচ্ছেন না। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে নানা ধরনের স্বীকারোক্তির কথা পুলিশ কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। অথচ এ ধরনের স্বীকারোক্তি আইনের চোখে গ্রহণীয় নয়। সভ্য জাতির সভ্য নীতি-মূল্যবোধ না মানলে দেশ সবার জন্যই বসবাসের অযোগ্য হতে বাধ্য। আমরা বুঝতে চাই বা না চাই, সমাজ সামগ্রিকভাবে সবার জন্য নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে।
বাস্তবে বিচার প্রক্রিয়া রাজনীতিকরণের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত অপরাধীদের আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা সহজ হচ্ছে। ফলে সুবিচার দূরে থাকুক, মানুষ মিথ্যা মামলা থেকে রক্ষা পেতে পারলেই যেন বাঁচে। একজন অপরাধী যদি গ্রেফতার এড়াতে পারে তাহলে কোনো কোর্টই তাকে সাজা দিতে পারে না।
শাসনতন্ত্রের অভিভাবক সুপ্রিমকোর্ট স্বাধীন প্রসিকিউশন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে বাধ্য করাতে পারেন। শাসনতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব পালনে সুপ্রিমকোর্টের দুর্বলতা সুপ্রিমকোর্টের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে।
স্বাধীন প্রসিকিউশন ভিন্ন শুধু বিচারকরা স্বাধীন হলেই ভুক্তভোগীদের জন্য সুবিচার নিশ্চিত হবে না। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ যে বিচারের নামে অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়ে চলেছে, তা জেনেও না জানার ভান করা ঠিক হবে না। দুর্নীতির দাপটে সুবিচার পাওয়ার বিষয়টি সাধারণ মানুষের আর্থিক ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বিচার ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
বিচার ব্যবস্থার নৈরাজ্য যে কোনো দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির অশুভ শক্তিসমূহকে সাহস জোগায়। আমরা সবাই যে দারুণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, তার মূলেও রয়েছে বিচারিক অব্যবস্থা। বিচার ব্যবস্থার শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতা রক্ষায় আমাদের ব্যর্থতা আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও বিবেকের দাবির সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করে চলছে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ barmainulhosein@gmail.com