বিচারপতিদের অবিচার! তদন্ত রিপোর্ট প্রধান বিচারপতির হাতে
লাবণ্য চৌধুরী : এবার বিচারপতিদের অবিচারের তদন্ত করেছে ৩ সদস্যর তদন্ত কমিটি। কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে প্রকৃত ঘটনা। বিচারপতিদের অবিচারের চিত্রও মিলেছে। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি কাছে। প্রধান বিচারপতি সুবিচার করবেন এটাই প্রত্যাশা নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে গত ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তিন সদস্যের জাজেস কমিটি গঠন করেন। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকার। কমিটি তিন থেকে পাঁচ দিন সুপ্রিম কোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শেষে একটি প্রতিবেদন প্রধান বিচারপতির কাছে জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রধান বিচারপতির বিবেচনায় রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্চ আদালতের ৩২ বিচারপতির বাসায় সরকারি কর্মচারীকে (এমএলএসএস) দিয়ে গৃহকর্মীর কাজ করতে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হয়েছে। এতে ১৯ বিচারপতির পরিবারের বিরুদ্ধে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের কথা উঠে এসেছে। এ ছাড়া ১৬ বিচারপতি ও সাতজনের পরিবারের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে, তাদের মুখের ভাষা অশালীন। এ বিষয়ের প্রেক্ষিতে তিন সদস্যের জাজেস কমিটি গঠন করে দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন এর অনুসন্ধানে মিলেছে, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে ১০২ বিচারপতি কর্মরত। একজন বিচারপতি প্রতি মাসে ৩২ হাজার টাকা গৃহস্থালি ভাতা পান। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বিচারপতির আদালতের চেম্বারের জন্য একজন পিয়ন এবং বাসার কাজের জন্য একজন করে দারোয়ান ও বাবুর্চি দেওয়া হয়। তবে বেশ কয়েকজন বিচারপতি প্রভাব খাটিয়ে তাদের বাসায় দুই থেকে ছয়জন এমএলএসএস নিয়েছেন। এর মধ্যে চার অবসরপ্রাপ্তসহ হাইকোর্ট বিভাগের ৩২ বিচারপতির বাসায় ৭০ জন (১০ নারীসহ) এমএলএসএসকে কাজে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে দাপ্তরিক কাজের সহায়তার জন্য ৪৫৪ জন এমএলএসএস কর্মরত। তাদের বেশির ভাগই এসএসসি পাস। কেউ কেউ স্নাতকোত্তর কিংবা এমবিএ ডিগ্রিধারীও রয়েছেন।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০১৪ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এমএলএসএস পদের নতুন নাম অফিস সহায়ক। তাদের কাজ মূলত অফিসে সীমাবদ্ধ।
১৯৬৯ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, অফিস সহায়করা অফিসের আসবাব ও রেকর্ড সুন্দরভাবে বিন্যাস, ফাইল ও কাগজপত্র স্থানান্তর, হালকা আসবাব সরানো, ফাইল অন্য অফিসে নেওয়া, কর্মকর্তাদের পানীয়জল পরিবেশন, মনিহারি ও অন্যান্য জিনিস সংরক্ষণ, ইউনিফর্ম পরা, কর্মকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা, ভদ্র ব্যবহার করা, ব্যাংকে চেক জমা ও টাকা তোলা, ১৫ মিনিট আগে অফিসে আসা এবং বিনা অনুমতিতে অফিস ত্যাগ করবে না।
কিন্তু আদালতের যেসব কর্মচারীকে বাসায় পাঠানো হয়, তাদের গৃহকর্মী, বাবুর্চি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতে বাধ্য করা হয়। সরকারি বন্ধের দিনও তাদের ছুটি দেওয়া হয় না।দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন এর হাতে আসা নথিতে অভিযুক্ত ৩২ বিচারপতির নাম রয়েছে। আপাতত তাদের নাম আমরা প্রকাশ করছি না।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ৩২ বিচারপতির বাসায় কর্মরত এমএলএসএসরা কোনো না কোনো দুর্ব্যবহার কিংবা অমানবিক আচরণের শিকার। এই কর্মচারীদের সাপ্তাহিকসহ অন্যান্য ছুটির প্রাপ্যতা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করানো হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে ভয়ভীতি। কর্মচারীদের দিয়ে শৌচাগার পরিষ্কার, মাছ কাটা, কাপড় ধোয়ানো, গৃহস্থালির সব কাজ করানো হচ্ছে। তা ছাড়া গায়ে হাত তোলা, অনাহারে রাখা, পকেটের টাকা দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে বাধ্য করা হয়।
এক নারী কর্মচারী জানান, কাকরাইলে এক বিচারপতির বাসভবনে ১১ বছর ধরে কাজ করেন। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের পরও ছোট দুটি সন্তান ও সংসারের কথা চিন্তা করে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন।অভিযোগ মিলেছে, আপিল বিভাগের এক বিচারপতির বাসায় গত বছর এক নারী কর্মচারীকে ধাক্কা মেরে ধারালো বঁটির ওপর ফেলে দেওয়া হয়। এতে তাঁর পেটের ডান পাশে ক্ষত হলে আটটি সেলাই দিতে হয়। তার পরও তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় বাসায় কাজ করতে হয়েছে। অথচ তিনি একজন বিচারপতি। মানুষের চিবার করেন। কিন্তু তাঁর ঘরেই অবিচারের আখড়া!
অভিযোগ করা হয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগের এক বিচারপতির স্ত্রী বাসায় থাকা নারী এমএলএসএসের হাতে-পায়ে গরম পানি ঢেলে দিয়েছিলেন। অথচ তাঁকে চিকিৎসকের কাছে না পাঠিয়ে বাসায় রেখে বিচারপতি মহোদয় সপরিবারে মার্কেটে চলে গিয়েছিলেন। ঘটনা জেনে পরে ওই নারীর স্বামী এসে এমএলএসএসকে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, এসব অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে জানানো হলেও কারও অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় না রহস্যজনক কারণে। ওদিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে এড়িয়ে থানা পুলিশে যেতে ভয় পান নিম্ন বেতনভুক এসব কর্মচারী। তাঁদের প্রশ্ন দেশে বৈষম্য বিরোধী এত আন্দোলন হলো, ফেসিস্ট সরকার পরিবর্তন হলো, বিচার বিভাগেরও পরিবর্তন হলো-কিন্তু বিচারপতিদের বাসার কর্মচারীদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না কেন!