বিচারক নিয়োগে দ্বৈত শাসন-রুল জারি
হাইকোর্ট রিপোর্টার : উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের পাঁচটি অনুচ্ছেদের অংশবিশেষ ‘কেন অবৈধ ঘোষণা করো হবে না’- তা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে হাই কোর্ট।
মন্ত্রিপরিষদসচিব, আইন সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলসহ চারজনকে চার সপ্তাহের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে। এক আইনজীবীর করা রিট আবেদনের ওপর দীর্ঘ শুনানির পর বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার এই রুল জারি করে। এতে সংবিধানের ৪৮ (৩), ৯৫, ৯৮, ১১৫, ১১৬ অনুচ্ছেদ কেন অবৈধ ঘোষণা করো হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
বিচারাঙ্গনে ‘দ্বৈত শাসনের’ বিষয়টি প্রধান বিচারপতি সামনে আনার পর নানামুখী আলোচনার মধ্যে সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদে দুই দফায় আনা সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ইউনুছ আলী আকন্দ গত ৩ নভেম্বর এই রিট আবেদন করেন।
৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ: সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী এবং ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কি না অথবা কী পরামর্শ দিয়েছেন, কোনো আদালত সে বিষয়ে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবে না।
৯৫ এর ১ অনুচ্ছেদ: রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ করবেন। ৯৫ এর ২ (বি) অনুচ্ছেদ: বাংলাদেশে ন্যূনতম দশ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে দায়িত্ব পালন না করলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হওয়ার যোগ্য হওয়া যাবে না।
৯৮ অনুচ্ছেদ: রাষ্ট্রপতি কোনো বিভাগের বিচারক সংখ্যা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি করা উচিত বলে মনে করলে তিনি যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন এক বা একাধিক ব্যক্তিকে অনধিক দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করিতে পারবেন, কিংবা তিনি উপযুক্ত বিবেচনা করলে হাই কোর্ট বিভাগের কোনো বিচারককে যে কোনো অস্থায়ী মেয়াদের জন্য আপিল বিভাগে আসন গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হতে কিংবা আরও এক মেয়াদের জন্য অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হতে এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই নিবৃত্ত করবে না।
বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে।
এই রিট আবেদনে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় আনা চতুর্থ সংশোধনী এবং ২০১১ সালে শেখ হাসিনার সময়ে করা পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ৯৫ এর ১ ও ২ এর বি এবং ১১৬ অনুচ্ছেদে আনা পরিবর্তনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন ইউনুছ আলী।
আদেশের পর তিনি বলেন, “এই ধারাগুলো বাহাত্তরের সংবিধানে এভাবে ছিল না। পরে দুই দফায় সংশোধন করে বর্তমান ধারাগুলো যুক্ত করা হয়েছে যা, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১০৯ অনুচ্ছেদ: হাই কোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকবে।
ইউনুছ আলী বলেন, “দেড় মাস ধরে শুনানির পর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে আদালত আজ রুল দিয়েছে।” ইউনুছ আলীর ভাষ্য, বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব ছিল সুপ্রিম কোর্টের হাতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে ওই ক্ষমতা দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির কাছে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এছাড়া সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে আইন তৈরি সাপেক্ষে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিধান থাকলেও সংসদে কোনো আইন ছাড়াই ৪৫ বছর ধরে বিচারক নিয়োগ দিয়ে আসাও ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ দাবি করে এই ধারা বাতিল চাওয়া হয়েছে তার আবেদনে।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নয় বছর পূর্তি উপলক্ষে গতবছর ৩১ অক্টোবর এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি ১১৬ অনুচ্ছেদকে বিচার বিভাগের ধীরগতির অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “দ্বৈত শাসনের ফলে বহু জেলায় শূন্য পদে সময়মত বিচারক নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিচার কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায়।”
১৯৭২ সালের সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে বাহাত্তরের বিধান আর ফেরেনি; অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলির ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতেই থেকে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃপ্রবর্তন করা ‘সময়ের দাবি’ বলে মত দেন প্রধান বিচারপতি।