বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার যত চেষ্ঠা ফল ততো উল্টো হচ্ছে
মারুফ কামাল খান: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি আট বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে দলটির ওপর দিয়ে রাষ্ট্রীয়, বিচারিক, প্রশাসনিক ও প্রচারিক হামলা চলে আসছে একটানা ও একতরফাভাবেই। এতে দলের কাঠামো প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এত বিপর্যয়ের পরেও এই দেশের জনসাধারণের মাঝে বিএনপির জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা কমা দূরে থাক, কয়েক গুণ বেড়েছে। এই অভাবিত ঘটনার কারণেই বিএনপিকে নিয়ে এই দলের প্রতিপক্ষের বিরামহীন মাথাব্যাথা একটুও কমছে না।
এরশাদ-মেনন-ইনুদের সংগে জোট বেঁধে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী এবং সমর্থক মিডিয়া-বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখির বেশিরভাগ জুড়েই থাকে বিএনপি-বিদ্বেষ ও বিএনপি-বিরোধী ক্যাম্পেইন। নিরপেক্ষতার ভেকধারী একদল প্রচারবিদও আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক আচরণ, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নগ্নতম দলীয়করণের কোনো সমালোচনা না করে এগুলো রোধ করতে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে বলে বিএনপিরই সমালোচনা করছে। দমন-পীড়ন-খুন-গুমের বিরোধিতা না করে এসব নিয়ে পরিহাস করছে বিএনপিকে।
কেউ কেউ অতি চাতুরি করে বলছে, জনপ্রিয়তা বাড়ার পেছনে বিএনপির কোনো কৃতিত্ব নেই। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণে তাদের সমর্থন কমে বিএনপির ঘরে যোগ হচ্ছে।
তবে বিএনপির ঘরে কেন? কেন জাতীয় পার্টি, বাম বিকল্প বা তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির ঘরে এই সমর্থন যুক্ত হচ্ছে না? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। বিএনপির সংগঠন দুর্বল হলেও তার রাজনীতি মোটামুটি সঠিক এবং এতে জনগণের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটে বলেই শত পীড়ন-চক্রান্ত-প্রচারণায় এ দলের জনভিত্তি কমানো যায় না- এই আসল সত্যটাই তারা আড়াল করতে চান। তবে একটা বিষয় তারা লুকাতে পারেন না যে, বিএনপি এখনো এ দেশের রাজনীতির অংগনে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাসংগিক দল। এই দলের অনুসৃত রাজনীতি যতদিন প্রাসংগিক থাকবে ততদিন বিএনপির অপরিহার্যতা কেউ মুছে দিতে পারবে না। আর পরিবর্তিত বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে বিএনপি যদি সময়ের চাহিদার আলোকে তার দর্শন, কর্মসূচি, কৌশল,এপ্রোচ ও সংগঠনকে বিন্যস্ত করে এগুতে পারে তবে এ দল অপ্রতিরোধ্যই থাকবে।
বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো বরাবরই একটু শিথিল। এ দল রেজিমেন্টেড বা মনোলিথিক নয়। এখানে সব শিয়ালের এক রা নয়। নানান মতের বিতর্ক ও পারষ্পরিক প্রতিযোগিতা আছে। এটা যেমন দুর্বলতা তেমনই বিএনপির শক্তি ও সৌন্দর্যও এখানে। বিএনপির প্রধান শক্তি দলীয় কাঠামোর বাইরে সমর্থক ও জনসাধারণের মধ্যে। কাজেই এ দল ভেঙে বা নেতা ভাগিয়ে কখনো তেমন লাভ হয়নি কারো।
জনগণের সম্মতি ছাড়া কৌশলে ক্ষমতায় বসা, দলীয়করণ করা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন-বিচারাঙ্গন-মিডিয়ার সমর্থনে ক্ষমতায় টেকা এবং পীড়ন ও অপপ্রচারে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পর্যুদস্ত রাখা যদি রাজনৈতিক সাফল্য হয় তবে আওয়ামী লীগ অবশ্যই সেই সাফল্যের দাবিদার। এটা নতুন কিছু নয়। দেশে দেশে যুগে যুগে এমন স্বৈরব্যবস্থা দাপটের সঙ্গে কিছুদিন রাজত্ব করার বহু নজির আছে। তবে দিন শেষে তাদের কারুর পরিণতিই শুভ হয়নি।
আওয়ামী লীগের সবচে বড় ব্যর্থতা হলো বিএনপিকে মানুষের মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না। যত চেষ্টা করছে ততো উল্টো ফল ফলছে। তাদের সবচে বড় ভুল হলো, বিএনপির রাজনীতি দেশের মানুষের কাছে সবচে বেশি প্রাসংগিক থাকতে এ দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা; যা কখনো সম্ভব নয়। এই ভুলের পেছনে তারা ক্রমাগত চেষ্টা চালাতে গিয়ে নিজেদের পরিণতিকেই অশুভ করে তুলছে। এই পরিণতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও স্বাভাবিক প্রতিযোগিতার পথ খুলে দেয়া।
বাংলাদেশের রাজনীতিকরাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা ও না থাকার মধ্যে বেহেশত ও দোজখের সমান ব্যবধান তৈরি করেছেন। আপনি ক্ষমতায় থাকলে বৈধ-অবৈধ সব কিছু করার অধিকার থাকে। পুলিশ, আইন, বিচার চলে অঙ্গুলি হেলনে। সব সম্মান-ইনাম-সুখ-সম্পদ-বাণিজ্য পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে। কারো কাছে কৈফিয়ত বা জবাবদিহি দিতে হয় না। স্তাবক-মোসাহেবরা অহর্নিশ স্তুতি ও কুর্ণিশ করতে থাকে। যখন যাকে খুশি হেনস্তা করা যায়। আহা! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে!
আবার সেই আপনিই যখন ক্ষমতা হারান কী অপনান! মামলা-মোকদ্দমা-জেল-তাড়ায় বিপর্যস্ত। রোগে-শোকে কাতর। রাস্তার লোকেরাও যত বড় মুখ নয় ততো বড় কথা বলে। আপনার স্বাভাবিক নাগরিক অধিকারও পর্যুদস্ত হয়। রুদ্ধ হয় ন্যায়বিচার পাবার পথ। নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয় পদে পদে। যেন আপনি এক দোজখবাসী।
এই তৈরি করা ব্যবধান এ দেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। বিনষ্ট করেছে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ। বৈধ-অবৈধ যে কোনো পন্থায় ক্ষমতায় যেতে প্রধান দলগুলো মরিয়া। কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে পারলে আর নামতে চায় না। ক্ষমতার স্বর্গচ্যুতির পাশাপাশি অক্ষমতার নরকে নামার ভয় তাদের তাড়া করে। ক্ষমতায় থেকে যে সব অন্যায় তারা করে তার প্রতিশোধের ভয়ে আরো বেশি করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। এই আঁকুপাঁকুতে ক্ষমাগত পিচ্ছিল হয়ে উঠে এবং একসময় তা হাত ফস্কে তা বেরিয়ে যায়। এগুলো কোনো তাত্ত্বিক কথা নয়, ইতিহাস-প্রমানিত নিরেট সত্য। রাজনীতিকরা এ সত্যটা কম-বেশি জানেন কিন্তু সত্য থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখেন। আর তাই এড়াতে পারেন না অনিবার্য বিপর্যয়।
বাংলাদেশকে এই অনিবার্য বিপর্যয় এবং অগণতান্ত্রিকতার সংষ্কৃতি ও ধারা থেকে বের করতে হলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার স্বর্গ ও নরক সমান ব্যবধান দূর করতে হবে। বিরোধী দলে গেলেই দোজখে পড়ার ধারা বন্ধ না হলে এবং বিরোধী দলের সম্মান প্রতিষ্ঠা করা না গেলে কেউ অপজিশনে যেতে চাইবে না। যখন যে আপার হ্যাণ্ডে থাকবে সেই ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ক্ষমতা করায়ত্ত্ব করার ও কব্জায় রাখার মরিয়া অপচেষ্টা চালাবে। সুস্থ প্রতিযোগিতা ফিরে আসবোনা কখনোই। নির্বাচনের নামে প্রহসন চলতেই থাকবে। কাজেই সবার আগে এই প্রশ্নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা জরুরি। তারজন্য যত দ্রুত আলোচনা ও সংলাপ শুরু করা দরকার।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছিল সেটা আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে উড়িয়ে দিয়েছে বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করে। কেবল সেই তিন মাসের তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাও এখন আর সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নির্বাচন কমিশনের যে চেহারা ঢাকা-চাঁটগার তিন সিটির ইলেকশনে দেখা গেছে তাতেই আমার এ ধারণা জন্মেছে। কাজেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করাটা শুধু বিএনপির দাবির বিষয় নয়, সব স্টেক হোল্ডার মিলে বিশদ আলোচনা করে এর একটা পথ বের করতে হবে। বিএনপি একটা ফর্মুলা দিল, আওয়ামী লীগ তার একটা খুঁত বের করে সেটা নাকচ করে দিল- এই চাতুরির খেলায় কোনো সমাধান আসবে না।
আমি যা বললাম এগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সুষ্ঠু সমাধানের পথ। আওয়ামী লীগ ভাবতে পারে একেবারে বাধ্য না হলে কেন সে এই পথে আসবে? অথবা জবরদস্তির পথে ক্ষমতা আয়ত্বে রাখাই সে উত্তম পথ বলে বিবেচনা করতে পারে, আখেরে পরিণতি যাই হোক।সিদ্ধান্ত তাদের, স্টিয়ারিং যেহেতু হাতে আছে।
লেখক : সাংবাদিক এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস সেক্রেটারি