বিআরটিএর বাজার গরম-ফিটনেস সনদ নেওয়ার হিড়িক
প্রিয়া রহমান.ঢাকা:
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড়
অবৈধ মোটরযান এবং লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। গতকাল সোমবার সকাল থেকে এ অভিযান শুরু হয়।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) বিজয় ভূষণ পাল বলেন, ‘সারা দেশে প্রথম দিনে কতটি অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কাল (মঙ্গলবার) বিকাল নাগাদ নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজধানীর তিনটি পয়েন্টে অভিযান চালিয়ে প্রথম দিনে প্রায় একশ গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।’ অন্যদিকে বিআরটিএ’র একটি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল বিকাল ৩টা পর্যন্ত রাজধানীতে ৭৭টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, মোট ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা, একজন চালককে ৫ দিনের জেল, একটি গাড়ি ধ্বংস ও দুইটি গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল দুপুর নাগাদ সারা দেশে ৫ শতাধিক যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে গাজিপুরেই দেড় শতাধিক মোটরযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ অভিযান আপাতত লাগাতার চালানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে বিআরটিএ’র। তবে কতদিন লাগাতার এ অভিযান চলবে তা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে বলে বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে এ অভিযানের খবরে রাজধানীসহ বিভিন্ন মহানগরী ও জেলা শহরে গণপরিবহন সংকট দেখা দেয়। যে সব পয়েন্টে আভিযানিক দল চেকপোস্ট বসিয়েছে তা এড়িয়ে চলতে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করছিলো অবৈধ যানবাহন এবং হাতুড়ে চালকরা।
এতে ঢাকা মহানগরীসহ অন্য নগরেও যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া অভিযানের খবর পেয়ে অবৈধ বা ক্রুটিপূর্ণ যানবাহনগুলো সড়কে না নামায় তীব্র যানবাহন সংকট দেখা দেয়। এতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। বিশেষ করে অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী ও জরুরি কাজ সারতে বের হওয়া নাগরিকরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে।
গতকাল সকালে রাজধানীর কয়েকটি পয়েন্টে দেখা গেছে অফিসগামী যাত্রীর ‘মিছিল’। তবে গণপরিবহন তেমন একটা মিলছিলো না। একটি বাস দেখলেই সেটির দিকে হুমড়ি খেয়ে দৌড়াচ্ছিলেন যাত্রীরা। বাসের গেটে ঝুলেও গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে যাত্রীদের। অন্যদিকে এ সুযোগে এক শ্রেণীর চালক যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছেন। সব মিলিয়ে অভিযানের খবরে মানুষ খুশি হলেও পরিবহন সংকটে তারা তিক্ত।
এছাড়া অভিযানকে গতিহীন করতে যানবাহন মালিকরা পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম পরিবহন সংকট সৃষ্টি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা বিধান ও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং আঞ্চলিক মহাসড়কে অবৈধভাবে চলাচলকারী নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ বিভিন্ন যানবাহনের বিরুদ্ধে চলমান রয়েছে এই অভিযান।
বিভিন্ন মহানগরীসহ সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে একযোগে এই অভিযান পরিচালনা করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়ররা। রাজধানীতে কারওয়ানবাজার, গাবতলী ও কাকলী এই তিনটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করে বিআরটিএ। এছাড়া ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আরও তিনটি স্থানে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়।
গত ২৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে একটি চিঠি দেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে গতকাল থেকে অভিযান শুরুর নি র্দেশ দেয়া হয়। সেই মোতাবেক এ অভিযান চলমান রয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি দেশের মহাসড়কগুলোতে বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
এছাড়া অবৈধ, ফিটনেসবিহীন ও লক্কড়-ঝক্কড় মোটরযান বেপরোয়া চলাচলের ফলে মহাসড়কে শৃঙ্খলা বিধান কঠিন হয়ে পড়েছে। এ কারণে ১০ নভেম্বর সোমবার থেকে অভিযান পরিচালনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ সুপার ও হাইওয়ে পুলিশ এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ করা হয়। তবে কতদিন এ অভিযান চলবে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
এত দিন কোনো গা না করেই ব্যবসা চালিয়েছেন পরিবহনমালিকেরা। তবে গতকালের অভিযানকে কেন্দ্র করে চলাচলের উপযোগী (ফিটনেস) সনদের জন্য সবাই ধরনা দিয়েছেন বিআরটিএর কার্যালয়গুলোতে। একই সঙ্গে গ্যারেজগুলোতে চলছে রং-চল্টা উঠে যাওয়া যান মেরামতের ধুম।
বিআরটিএর হিসাবে সারা দেশে সোয়া তিন লাখ যানবাহন ফিটনেস সনদ ছাড়া চলছে। শুধু ঢাকায় চলছে ৯৩ হাজার। এর বাইরে প্রায় আট লাখ নছিমন, করিমন, ভটভটি ও ইজিবাইক চলে, যার কোনো নিবন্ধন-ফিটনেস কিছুই নেই।
তবে অভিযানের আতঙ্কে রাস্তায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় যানবাহন কমেছে অনেক। এতে আখেরে ভুগতে হয়েছে জনগণকে। ঢাকার রাস্তায় বাসস্ট্যান্ডগুলোসহ বিভিন্ন স্পটে শত শত মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। দিতে হয়েছে বেশি ভাড়া।
অভিযান শুরু হওয়ার পর ফিটনেস সনদ নেওয়ার হিড়িক লেগেছে বিআরটিএর কার্যালয়ে। সংস্থাটির মিরপুর কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, শুধু এই কার্যালয়েই তিন দিন ধরে গড়ে ৮০০ যানবাহন ফিটনেস সনদ নিতে আসছে। অন্য সময় দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়া হতো।
এতগুলো যানবাহনের ফিটনেস সনদ দিতে বিআরটিএর পরিদর্শক মাত্র সাতজন, অন্য ছোট কর্মী মিলিয়ে মোট জনবল ১৩ জন। ফলে বাইরের রং দেখেই ফিটনেস সনদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ কারিগরি ও বাহ্যিক অন্তত ৩০টি বিষয়ের সঠিকতা যাচাই করেই সনদ দেওয়ার কথা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ঢাকায় ৫০ শতাংশ বাস-মিনিবাস ভয়ে রাস্তায় নামেনি, মেরামত চলছে। অনেকে ফিটনেস সনদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে।
এত দিন কেন সেটা করা হয়নি, জানতে চাইলে এনায়েত বলেন, আসলে বাধ্য না হলে কেউ ঠিক করতে চায় না। আর ঢাকায় দু-তিন মাসের মধ্যেই ঘষাঘষির কারণে রং-চল্টা উঠে যায়। তিনি বলেন, অভিযানে আপত্তি নেই। তবে কারও যেন হয়রানি না হয়।
প্রায় দেড় কোটি মানুষের ঢাকায় বাস-মিনিবাসের অনুমোদন আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের। অটোরিকশা সংখ্যায় প্রায় ১২ হাজার। এর বাইরে আছে কিছু হিউম্যান হলার। এই হচ্ছে মোটা দাগে ঢাকার গণপরিবহন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অভিযান দেখতে গতকাল বিকেলে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে যান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে যে অভিযান চলছে, তা অব্যাহত থাকবে।
অভিযানের কারণে বাসের বিকল্প পথ ধরে চলা ও যাত্রী ভোগান্তির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এসব কাজ করতে গেলে কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে। রাতারাতি বিকল্প দেওয়া যাবে না। দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে হলে সাময়িক একটু কষ্ট করতেই হবে।’
অভিযানে জেল-জরিমানা: রাজধানীতে গতকাল দুপুর পর্যন্ত গাবতলী, কারওয়ান বাজার ও কাকলীতে তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিআরটিএ। বিকেলে সব কটি আদালত মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এসে আবার আদালত পরিচালনা করেন।
ঢাকার চারটি আদালতে বিকেল পর্যন্ত ৯২টি মামলা হয়। তাৎক্ষণিক জরিমানা আদায় করা হয় এক লাখ ১৬ হাজার টাকা। দুজন চালককে ১৫ দিন করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় লাইসেন্স না থাকায়। এ ছাড়া দুটি বাস জব্দ করা হয়।
গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিকেল পর্যন্ত ৭২০টি মামলা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। চারটি যানবাহন জব্দ এবং তাৎক্ষণিক জরিমানা করা হয় অনেককে।
যানবাহন জব্দ-দুর্ভোগ
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। রাজধানীর বাংলামোটর থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন স্পটে শত শত লোক দাঁড়িয়ে। একটি বাস আসার পর একসঙ্গে ২০-৩০ জন যাত্রী ওঠার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। আগে থেকেই বাসের ভেতর যাত্রীতে ঠাসা থাকায় দু-তিনজন কোনোরকমে বাসের দরজায় উঠতে পারছেন। বাকিদের তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
একই অবস্থা দেখা গেছে সকালে কল্যাণপুর ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনেও। বেলা তিনটার দিকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও কারওয়ান বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলার সময় ফার্মগেটে কয়েক শ যাত্রীকে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।
বিব্রত মন্ত্রী –মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম দেখে ফিরে যাচ্ছিলেন ওবায়দুল কাদের। এ সময় মন্ত্রীর গাড়ির সামনে দিয়েই দুটি মিনিবাস ছাদে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ হাত ইশারায় মিনিবাস দুটি থামাতে গেলে জয় বাংলা বলে হইচই করে ওঠেন ভেতরের এবং ছাদের যাত্রীরা। পুলিশ ছেড়ে দেয়। কিন্তু উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীরা এর ছবি ও ভিডিও ধারণ করা শুরু করলে পুলিশ দৌড়ে গিয়ে একটি মিনিবাস আটক করে। অন্যটি ততক্ষণে চম্পট দেয়।
বাসের যাত্রীরা জানান, মহানগর নাট্যমঞ্চে যুবলীগের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সাভারে ফিরে যাচ্ছিলেন তাঁরা। বাস দুটি আরিচা থেকে গাবতলী পথে চলে। এই দুটি বাস যাওয়ার আগে বিআরটিএর পক্ষ থেকে মাইকে বারবার প্রচার করা হচ্ছিল, ছাদে যাত্রী বহন করা অপরাধ।