বাঘের গর্জনে ওলট-পালট পাকিস্তান
স্পোর্টস রিপোর্টার.ঢাকা: বাঘের গর্জনে ওলট-পালট পাকিস্তান । টস জিতেশুরু হতে থাকে নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি।
অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ পাকিস্তানের–
সাকিব বলেছেন সেই কবে, ‘আমরাই ফেবারিট।’ এবার অন্য কিছু হবে, বলেছেন মাশরাফি-নাসিররা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই ইনিংসে জোড়া সেঞ্চুরি করে, নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩২৯ রানের ইনিংসটা গড়ে, পাকিস্তানকে ২৫০ রানে গুটিয়ে দিয়েও সাকিবরা আবেগটা পেশাদারির খোলসেই লুকিয়ে রাখলেন। এই বাংলাদেশ যেন অন্যরকম!
তামিমের ১৩৫ বলে ১৩২ আর মুশফিকের মাত্র ৭৭ বলে ১০৬, তৃতীয় উইকেটে দুজনের ১৭৮ রানের জুটিটাই এনে দিয়েছিল বড় পুঁজি। কিন্তু বাংলাদেশের আগের দলীয় সর্বোচ্চ ৩২৬ ছিল এই পাকিস্তানের বিপক্ষেই, এই মিরপুরেই। তা ছাড়া ১৬ বছর ধরে একটা গেরো খুলতে না পারার মানসিক বাধা তো ছিলই। পাকিস্তানের বিনা উইকেটে ৫৩ রান তুলে ফেলা, তৃতীয় উইকেটে আজহার আলী আর হারিস সোহেলের একটু একটু করে এগিয়ে নেওয়া ৮৯ রানের জুটিটা সেই চোখ রাঙানিই দিচ্ছিল। ২ উইকেটে পাকিস্তানের স্কোর যে ১৪৮!
কিন্তু সেখান থেকেই দুর্দান্তভাবে ম্যাচে ফিরে এল বাংলাদেশ। ৬৯ রানের ব্যবধানে তুলে নিল পাকিস্তানের চার উইকেট। এ ক্ষেত্রে বাহবা পাবেন তরুণ তাসকিন আহমেদ। চার উইকেটের দুটোই তাঁর। একটি আজহার আলীর, অন্যটি হারিস সোহেল। মিসবাহ জায়গায় আজহারকে অধিনায়ক করায় পাকিস্তানেই হাসাহাসি হচ্ছিল। এসে গেছে আরেক ‘টুকটুক’। মারকাটারি ক্রিকেটের এই যুগে বড্ড বেমানান স্ট্রাইক রেটের অধিকারী আজহার নতুন দায়িত্ব পেয়েই যেন নতুন করে নিজেকে চেনাচ্ছিলেন। ৭৩ বলে করলেন ৭২। মাত্র ১৮তম ওয়ানডে খেলতে নামা সোহেল ৬৪ বলে করলেন ৫১। ইনিংসের একমাত্র ছক্কাটিও তাঁর।
সেই ছক্কা হজম করেছেন যিনি, সেই আরাফাত সানিই আজ বল হাতে নায়ক। বিশ্বকাপে মাত্র এক ম্যাচে সুযোগ পাওয়া সানি তাসকিনের পাশাপাশি সেই চার উইকেটের দুটো ভাগ করে নিলেন। সেটাও এক ওভারেই। হুট করেই পাকিস্তান ৬ উইকেটে ২১৭!
এর মধ্যে টানা ছয় ওভার বাংলাদেশের বোলাররা করল অবিশ্বাস্য বোলিং। ৩১ থেকে ৩৬-এই ৩৬ বলে দিল মাত্র ২০ রান, একটাও বাউন্ডারি হয়নি। রান রেটের চাপ গলার ফাঁস হয়ে বসল পাকিস্তানিদের ওপর। অভিষিক্ত মোহাম্মদ রিজওয়ান একা লড়াই করার চেষ্টা করলেন। ৫৮ বলে তাঁর ৬৭ রানের ইনিংসটাও দুশ্চিন্তার রেখা বাড়াল। কিন্তু এই বাংলাদেশ যে অন্য রকম। ওয়াহাব রিয়াজ ‘স্লেজিংয়ে’র চালে ওয়াটসনের বিপক্ষে জিতেছেন, আজ হারলেন রুবেলের কাছে। পুরো পাকিস্তানই অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করল।
বিশ্বকাপের পর দুদলেরই প্রথম ম্যাচ
বিশ্বকাপের পর দুদলেরই প্রথম ম্যাচ। আর প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশ দলে বিশ্বকাপ অধিনায়ক মাশরাফির জায়গায় সাকিব, পাকিস্তান দলে মিসবাহর জায়গায় আজহার। পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ তিন ম্যাচেই টস জিতেছিল বাংলাদেশ। আজও টস বাংলাদেশই জিতল। টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন সাকিব। এর পরই শুরু হতে থাকে নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টির উপলক্ষ।
আজ তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম দুজনই সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন। এর আগে একই ম্যাচে বাংলাদেশ একাধিক ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করেননি। তামিম ইকবাল করেছেন এক ইনিংসে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩২ রান। এই ইনিংসটা যেকোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটাও অবশ্য তামিমের। ২০০৯ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৫৪ রান করেছিলেন। আর মুশফিক আজ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন মাত্র ৬৯ বলে। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এটা দ্রুততম সেঞ্চুরির তালিকায় ৩ নম্বরে আছে। সাকিব আল হাসানের ৬৩ ও ৬৮ বলে সেঞ্চুরি আছে।
তামিমের ১৩২ পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো বাংলাদেশির সর্বোচ্চ ইনিংস। আগেরটি ছিল সাকিবের ১০৮। পাকিস্তানের বিপক্ষে মোট রানেরও সাকিবকে টপকে গেছেন তামিম। পাকিস্তানের বিপক্ষে সাকিবের রান ৪৮২, তামিমেরটা বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪৯৬। আজ সাকিবকে টপকে বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের মালিকও হয়েছেন তামিম। সাকিবের রান ৪ হাজার ২০৪, তামিমের ৪ হাজার ২৫৭। বাংলাদেশের পক্ষে সাকিব-তামিম ছাড়া আর কারো চার হাজার রান নেই।
আজ তামিম-মুশফিক জুটি যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ ১৭৮ রানের রেকর্ড গড়েছেন। ৬৭ রানেই ২ উইকেট যাওয়ার পর ৩য় উইকেটে এই জুটি গড়েন ২১.৪ ওভারে। এই জুটির ওভার প্রতি রানরেট ছিল ৮.২১। ওয়ানডে ইতিহাসে তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৮-এর বেশি রানরেটে ১৭৫+ রান করার ঘটনা ঘটেছে মাত্র তিনবার।
বাংলাদেশ আজ দলীয় সর্বোচ্চ ৩২৯ রানের রেকর্ড গড়েছে। আগের সর্বোচ্চ ৩২৬ রানও ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে গত বছর এশিয়া কাপে। আবার পাকিস্তান ৩৩০ রান তাড়া করে কখনো ওয়ানডে জিততে পারেনি। আজকে জিততে হলে তাই তাদের নতুন রেকর্ডই করতে হবে।
মাত্রই নিষেধাজ্ঞা থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছেন সাঈদ আজমল। আর ফেরার পরই করলেন নিজের ১১২ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে বোলিং। আজ ১০ ওভার বল করে ৭৪ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি। ওয়ানডেতে আর কখনোই আজমলকে এত রান দিয়ে উইকেট শূন্য থাকতে হয়নি।
এক ইনিংসে দুই ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি
নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে আগে কখনোই এক ইনিংসে দুই ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি দেখেনি বাংলাদেশ। আজ মিরপুরে প্রথমবারের মতো এমন কীর্তির সাক্ষী হল বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। তামিম ইকবাল তাঁর নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করে খেললেন ১৩২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। নিজেকে ধারাবাহিকতার প্রতীক প্রমাণ করতে মুশফিকুর রহিমও স্কোরবোর্ডে তুললেন ১০৬ রান। দুজনের ১৭৮ রানের যুগলবন্দী ঠাঁই করে নিল ইতিহাসে। সব কীর্তিগাথার মিলিত যোগফলে বাংলাদেশও সংগ্রহটাকে নিয়ে গেল নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ-৩২৯ রানে।
টসে জিতে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের ব্যাটিং শুরু থেকেই দেখাচ্ছিল অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী। তামিম ইকবাল আর সৌম্য সরকারের উদ্বোধনী জুটিই শুরুটা করে দিয়েছিলেন। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই মিরপুরে পাকিস্তানি বোলারদের সাধারণের কাতারে নামিয়ে নিয়ে এসে বাংলাদেশ নিজেদের নিয়ে গেল অন্য এক উচ্চতায়।
তামিমের ১৩২ রানের ইনিংসটি আসে ১৩৫ বলে। ১৫ চার ও ৩ ছয়ের এই ইনিংসটি তামিমের জীবনের সেরা ইনিংস কিনা, সে আলোচনা কিন্তু আসতেই পারে। তবে তামিমের এই ইনিংসটি যে ক্রিকেটপ্রেমীরা অনেক দিন মনে রাখবেন, সেটা কিন্তু বলে দেওয়া যায় কোনো বিতর্ক কিংবা আলোচনা ছাড়াই।
মুশফিকের ইনিংসটিও কিন্তু এক কথায় অনবদ্য। কোন ফাঁক দিয়ে তিনি তিন অঙ্কে পৌঁছে গেলেন, সেটা তিনি আজ টেরই পেতে দেননি। মাত্র ৭৭ বলে ১৩ চার ও ২ ছয়ে সাজানো তাঁর সেঞ্চুরিটিই আত্মবিশ্বাসের একেবারে তলানিতে ঠেলে দেয় পাকিস্তানি বোলারদের।
সাঈদ আজমলকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল। বোলিং অ্যাকশনের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে ফিরে আজ আজমল তেমন কিছুই করতে পারেননি। ১০ ওভারে দিয়েছেন ৭৪ রান। প্রথম ৬ ওভারে মাত্র ২৫ রান দিলেও তামিম ও মুশফিকের তাণ্ডবে শেষের দিকে খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। বিশ্ব সেরা অফ স্পিনারকে আজ মিরপুরের মাঠে মনে হচ্ছিল বড় অসহায়, নিঃস্ব-রিক্ত।
বাংলাদেশের ইনিংসে তামিম, মুশফিকের দুটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩১ রান এসেছে সাকিবের ব্যাট থেকে। তাঁর ২৭ বলের ক্যামিওটিই বাংলাদেশের সংগ্রহকে তিনশর কোটা পার করিয়ে দেয়। সৌম্য সরকার উদ্বোধনী জুটিতে দারুণ সঙ্গ দিয়েছিলেন তামিমকে। কিন্তু ২০ রানের মাথায় অবিবেচকের মতো রান আউট না হলে বড় কিছুই করতে পারতেন। সেই ক্ষেত্র প্রস্তুতই ছিল।
বিশ্বকাপের পারফরমার মাহমুদউল্লাহ আজ ব্যর্থ। মাত্র ৫ রানে রাহাত আলীর বলে বোল্ড হন তিনি। সাব্বির শেষের দিকে ব্যাট হাতে নেমে সাধ্যমতোই চেষ্টা করেন। একটি ছয় ও একটি চারে করেন ১৫।
পাকিস্তানের সেরা বোলার ছিলেন ওয়াহাব রিয়াজই। ৪ উইকেট নিলেও খরচ করেছেন ৫৯ রান। অপর উইকেটটি রাহাত আলীর।
বাংলাদেশের ইনিংসের সেরা দিক ছিল শেষ দশ ওভার। এই ৬০টি বলে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৯৩ রান। ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে বিনা উইকেটে ৫৫ রান তুলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা আজ নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন দুর্দান্তভাবেই।