বাংলাদেশ-ভারত শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ ‘টাই’
স্পোর্টস রিপোর্টার : অবশেষে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ ‘টাই’ হয়েছে। মানে কেউ হারেনি। প্রথম বাংলাদেশি নারী ক্রিকেটার হিসেবে ফারজানা হকের ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করার দিনটায় বাংলাদেশ হারেনি। নারী ওয়ানডে এর আগে ৮টি ‘টাই’ দেখলেও বাংলাদেশের নারী দলের জন্য এই অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। বাংলাদেশের ২২৫ রানের জবাবে রোমাঞ্চকর এক ম্যাচ রান তাড়ার দিন ভারতের রান থেমেছে ২২৫–এ। সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে কোনো দল না জেতায় সিরিজেও সমতা। প্রথম ম্যাচে জিতেছিল বাংলাদেশ, দ্বিতীয় ম্যাচে ভারত। তিন ম্যাচ সিরিজ তাই ১-১ ড্র।
জয়ের জন্য ভারতের দরকার ৬ বলে ৩ রান। বাংলাদেশের ১ উইকেট। বিসিবির প্রেসিডেন্ট বক্সে তখন ভিড় বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ ও ভারতীয় নারী দলের ড্রেসিংরুমের সামনের ডাগআউটেও ক্রিকেটার ও কোচদের ভিড়। আধঘন্টা আগে ব্যথা পেয়ে মাঠ ছেড়ে যাওয়া মারুফা আক্তার শেষ ওভারটা করতে ফিরে আসেন। প্রথম দুই বলেই ক্রিজে থাকা দুই ব্যাটার জেমিমা রদ্রিগেজ ও মেঘনা সিং দুটি সিঙ্গেল নেওয়ার পর পুরো মিরপুরই ধরে নিয়েছিল—ম্যাচটা ভারতই জিতছে।
কিন্তু সেই ওভারের তৃতীয় বলেই মারুফাকে লেট কাট করতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হয়ে যান মেঘনা। মিরপুরে তখন ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ ‘টাই’ হওয়ার আনন্দ। বাংলাদেশ দলের ডাগআউটে কোচ ও সাপোর্ট স্টাফদের মধ্যেও যেন ম্যাচ জয়ের আনন্দ। সে দৃশ্যটা কিছুক্ষণ নন স্ট্রাইক প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন জেমিমা।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ নারী দলের জন্য দুই শ রান বড় এক আনন্দের উপলক্ষ। এর আগে ৫৬টি ওয়ানডে খেলা বাংলাদেশ নারী দল মাত্র ৬ বার দুই শ’র বেশি রান করেছে। আজ করল সপ্তমবারের মতো। ৪ উইকেটে ২২৫ ঘরের মাঠে খেলা ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ ভারতের বিপক্ষেও। সব মিলিয়েই এটা ওয়ানডেতে বাংলাদেশের মেয়েদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা জমিয়ে তোলার জন্য এই রান যথেষ্ট মনে হচ্ছিল। তবে সেই ম্যাচের শেষ যে এমন নাটকীয়তাময় হবে, কে জানত!
সেই নাটকীয়তায় মাত্রা যোগ করেছে বৃষ্টিও। বৃষ্টির কারণে প্রায় ৪০ মিনিট খেলা বন্ধ ছিল। যদিও কোনো ওভার নষ্ট হয়নি তাতে। সে সময় জয়ের জন্য ভারতের দরকার ছিল ৭২ বলে ৫৩ রান। বৃষ্টির পর ফাহিমা খাতুনের করা প্রথম ওভারেই হারলিনকে ফেরানোর সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু মিড উইকেট বাউন্ডারিতে লতা মন্ডল ডাইভ দিয়েও ক্যাচটা লুফে নিতে পারেননি। তবে বাংলাদেশ হাল ছাড়েনি। বাউন্ডারি–বল না দিয়ে আঁটসাঁট বোলিং করেছেন নাহিদা-ফাহিমারা। এর মধ্যে চোটের কারণে মারুফাকেও হারিয়েছে বাংলাদেশ।
ইনিংসের ৪২তম ওভারে কাঙ্ক্ষিত উইকেটের দেখা পায় বাংলাদেশ। পরপর দুটি রান আউটে ফিরে আসে ম্যাচেও। প্রথমে আউট হন হারলিন দেওল। ফুল টস বল পয়েন্টে ঠেলে সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফাহিমা ডাইভ দিয়ে বল থামালে ক্রিজের অনেকটা বাইরে গিয়ে হারলিন আবার ফেরত আসার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে গ্লাভসে ফাহিমার দারুণ এক থ্রো’র সৌজন্যে স্টাম্প ভাঙ্গেন নিগার। ১০৮ বলে ৭৭ রান করা থিতু ব্যাটার হারলিনের বিদায়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন বাংলাদেশের মেয়েরা। তিন বল পর জেমিমার কাভার ড্রাইভে দৌড়ে রান গিয়ে রান আউট হন সদ্য ক্রিজে আসা দীপ্তি শর্মা। এবার সোবহান মোস্তারির সরাসরি থ্রো ভেঙে দেয় স্ট্রাইকিং প্রান্তের স্টাম্প। ভারতের স্কোর তখন ৬ উইকেটে ১৯২ রান। জয়ের জন্য তাদের প্রয়োজন তখন ৪৮ বলে ৩৪ রান। তখনো ম্যাচ ভারতেরই হাতে বলা যায়।
সেই ধারা অনুযায়ীই ভারতীয় ইনিংস এগিয়ে যাচ্ছিল জেমিমার ব্যাটে চড়ে। ১৮ রানে সুলতানার বলে শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ তুলেছিলেন, কিন্তু রিতু মনি লাফিয়েও তা ধরতে পারেননি। যদিও অন্য প্রান্তের উইকেট পতন তিনি থামাতে পারছিলেন না। ভারতীয় লোয়ার অর্ডার ব্যাটার আমনজত কৌরকে (১০) এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন রাবেয়া। ৪৮তম ওভারে এসে নাহিদা ফেরান স্নেহ রানা (০) ও দেবিকা বৈদ্যকে (০)।
জয়ের জন্য তখন বাংলাদেশের দরকার ১ উইকেট, ভারতের ৯ রান। হাতে আছে ১২ বল। ৩১ রানে অপরাজিত জেমিমা তখন স্ট্রাইকে। সুলতানার করা ৪৯তম ওভারের প্রথম দুই বলে কোনো রান না নিলেও তৃতীয় বলে ১ রান নেন জেমিমা। সেই ওভারের পঞ্চম বলে মেঘনা সিং স্লগ সুইপে বাউন্ডারি মারেন। একই ওভারের শেষ বলে লং অফ দিয়ে উড়িয়ে মেরে দৌড়ে ১ রান নিয়ে শেষ ওভারের জন্য স্ট্রাইক নেন মেঘনা।
এর আগে বাংলাদেশকে বল হাতে ভালো শুরু এনে দিয়েছিলেন মারুফা আক্তার। নিজের করা প্রথম ও ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই স্মৃতি মান্ধানার ব্যাটের কানা খুঁজে নিয়েছিলেন। কিন্তু উইকেটকিপার নিগার সুলতানা সহজ ক্যাচটা ধরতে পারেননি। সেই ওভারেই অবশ্য আরেক ওপেনার শেফালি বর্মাকে আউট করেন মারুফা। ফুল লেংথের বলে সোজা খেলতে গিয়ে মারুফার হাতে ক্যাচ তোলেন শেফালি (৪)। দারুণ দক্ষতায় ফিরতি ক্যাচটা নিয়েছেন মারুফা। তিনে নামা যষ্ঠিকা ভাটিয়ার ইনিংস বড় হতে দেননি সুলতানা খাতুন।৩২ রানে ২ উইকেট হারানোর পর ভারত ঘুরে দাঁড়ায় মান্ধানা ও হারলিন দেওলের জুটির সৌজন্যে। তৃতীয় উইকেটে দুজন গড়েছেন ১৪২ বলে ১০৭ রান। শূন্য রানে জীবন পাওয়া মান্ধানার ব্যাট থেকে আসে ৮৫ বলে ৫৯। ইনিংসের ২৯তম ওভারে ফাহিমা খাতুনের বলে কাট খেলতে গিয়ে পয়েন্টে ক্যাচ তোলেন ভারতীয় সহ-অধিনায়ক।
ম্যাচের ভাগ্য ঘুরতে শুরু করে তখন থেকেই। হারলিন ফিফটি করলেও নতুন ব্যাটার হিসেবে ক্রিজে আসা হারমানপ্রিত কৌর চাপে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৩৪তম ওভারে নাহিদা আক্তারের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন তিনি (১৪)। তবে আম্পায়ার তানভীর আহমেদের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট মনে হয়নি তাঁকে। আউটের সিদ্ধান্তের পর ক্ষোভে ব্যাট দিয়ে স্টাম্প ভেঙে ফেলেন ভারতীয় অধিনায়ক। মাঠ ছাড়েন আম্পায়ারের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হানতে হানতে। দর্শকদের দিকেও আঙুল তুলে কিছু একটা বলেছেন।
সকালে টসজয়ী বাংলাদেশ নারী দলের ইনিংসে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছেন ফারজানা হক। উদ্বোধনে নেমে ফারজানা আউট হন ইনিংসের শেষ বলে। বাংলাদেশের ৪ উইকেটে ২২৫ রানের মধ্যে ১০৭ রানই ফারজানার। বাংলাদেশ ইনিংসের অর্ধেকের বেশি বল (১৬০) খেলেছেন তিনি। ম্যারাথন ইনিংসে ডট বল ছিল ৮৯টি। ৭টি বাউন্ডারিতে সাজানো ফারজানার ইনিংসের এক-দুই রান থেকে এসেছে বাকি রান।
ভারতীয় বোলারদের পাশাপাশি ফারজানাকে লড়তে হচ্ছিল মিরপুরের প্রচণ্ড গরমের সঙ্গেও। কিন্তু তিনি দমে যাননি। শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জ উতরে যাওয়ার অদম্য মানসিকতা ফারজানাকে পৌঁছে দিয়েছে ইতিহাসে। সেই ইতিহাসটা কী? বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে সেঞ্চুরি করার কীর্তি।
দেশের হয়ে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির দিনে আরেকটি কীর্তি গড়ার কাছাকাছিও পৌঁছে গিয়েছিলেন ফারজানা। উদ্বোধনী ব্যাটার হিসেবে নেমে উইকেটে টিকে ছিলেন পঞ্চাশতম ওভার পর্যন্ত। ইনিংসের শেষ বলে রান আউট হয়ে যাওয়ায় অপরাজিত থেকে ফিরতে পারেননি।সিরিজের ট্রফিটা ভাগাভাগি করেছে দুদল।
বাংলাদেশ ইনিংসে এর বাইরে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন ফারজানার ওপেনিং সঙ্গী শামীমা সুলতানা। তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৭৮ বলে ৫২ রান। ৫টি চার ছিল তাঁর ইনিংসে। ফারজানার সঙ্গে শামীমার উদ্বোধনী জুটি ৯৩ রানের। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে অধিনায়ক নিগার সুলতানার (২৪) সঙ্গে আরও ৭১ রান যোগ করেন ফারজানা। শেষের দিকে সোবহানা মোস্তারির (২৩) সঙ্গে গড়েন ৫৬ রানের জুটি। তিনটি ৫০ ছাড়ানো জুটির সৌজন্যে বাংলাদেশের স্কোর দুই শ ছাড়ায়। নারী ওয়ানডেতে এই প্রথম প্রথম তিনটি ৫০ ছাড়ানো জুটি বাংলাদেশের। এই ম্যাচে অনেক ‘প্রথম’–এর মধ্যে সবচেয়ে বড় তো অবশ্যই শেষের ওই প্রথম। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের মেয়েদের প্রথম ‘টাই’।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২২৫/৪ (শামীমা ৫২, ফারজানা ১০৭, নিগার ২৪, রিতু ২, সোবহানা ২৩*; স্নেহ ২/৪৫, দেবীকা ১/৪২)। ভারত: ৪৯.৩ ওভারে ২২৫ (হারলিন ৭৭, স্মৃতি ৫৯, জেমিমা ৩৩*, হারমানপ্রীত ১৪, দীপ্তি ১০; নাহিদা ৩/৩৭, মারুফা ২/৫৫, রাবেয়া ১/৩০, ফাহিমা ১/৪৮, সুলতানা ১/৪৯)। ফল: টাই। সিরিজ: ৩–ম্যাচ সিরিজ ১–১ ড্র। প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ: হারলিন দেওল। প্লেয়ার অব দ্য সিরিজ: ফারজানা হক।