বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি কি বিপদজনক বাঁক নিচ্ছে?
বিবিসি : বাংলাদেশে একের পর এক হামলার ঘটনা কি নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষকদে ভাবাচ্ছে? বাংলাদেশে শিয়া মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে হামলার পর দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এর আগে একের পর এক সেক্যুলার ব্লগারদের ওপর হামলা, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা, বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ধর্মীয় নেতাদের হত্যার পর শিয়াদের এই সর্বশেষ হামলা— অনেকে এসবের মধ্যে একটি যোগসূত্রও দেখতে পাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক ডক্টর আলী রীয়াজ বলছেন বাংলাদেশে উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শ উৎসারিত সন্ত্রাস, সহিংসতা যেটা আগে অনুপস্থিত ছিল এখন সে পরিস্থিতির একটা পরিবর্তন ঘটছে।
‘‘আগে আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর কিছু কিছু হামলার ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে সামগ্রিকভাবে সেকটেরিয়ান ভায়োলেন্স বা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার নজির ছিল না।’’
তিনি মনে করছেন আশুরাকে উপলক্ষ করে শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক এই হামলা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার ক্ষেত্রে একটা নতুন মাত্রা যোগ করল।
বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও এবং রাজনীতিতে তাদের সরব উপস্থিতি না থাকলেও তাদের টার্গেট করার মূল কারণ তার মতে ‘‘ভিন্ন মত যারা অবলম্বন করছে তাদের ওপর হামলার প্রবণতার বাড়ছে।’’
ভিন্ন মত যারা অবলম্বন করছে তাদের ওপর হামলার প্রবণতার বাড়ছে।
ডঃ আলী রীয়াজ, অধ্যাপক, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি
‘‘দুঃখজনক হচ্ছে রাষ্ট্র যখন কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তখন যারা মনে করে সংখ্যালঘুদের ওপর তারা হামলা চালাতে পারবে, তারা সুযোগটা গ্রহণ করে।’’
তার মতে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গী সংগঠন বা বিভিন্ন রকম গোষ্ঠি আছে যারা এই ধরনের হামলার সুযোগ খোঁজে এবং যখন তারা দেখছে হামলাটা করে পার পাওয়া সম্ভব তখন তারা হামলাটা করছে। তারা এসব ক্ষেত্রে একটা বার্তা দিতে চায় যে ‘‘তারা এটা করতে পারে’’ এবং সেটাই ডঃ আলী রীয়াজের মতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক।
তিনি পাকিস্তানের উদাহরণ টেনে বলছেন পাকিস্তানে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস এবং সুন্নি গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বিভিন্ন রকম জঙ্গী গোষ্ঠির উত্থানের পেছনে মূল কারণ ছিল সেসময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা ছিলেন তারা নিজেদের ক্ষমতার ভিত শক্ত করতে যখন ব্যস্ত ছিলেন তখন সেই সুযোগে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার বীজ বপন হয়েছে।
তবে ঢাকার ইনষ্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত আবদুর রশিদ মনে করছেন না যে বাংলাদেশে একটা দুটো এধরনের হামলার ঘটনা দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে বিপদজনক একটা পথে ঠেলে দিচ্ছে বা রাষ্ট্র মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ।
ধর্ম নিয়ে যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করে, সামাজিক বিভাজনের সীমানাতেই তারা কিন্তু আঘাত করে।
মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত আবদুর রশিদ, ঢাকা ইনষ্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার বিষয়টি পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিয়ে ডঃ রীয়াজের বিশ্লেষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মিঃ রশিদ বলছেন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ঐতিহাসিক।
‘‘এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্যে – তা ভেঙে ফেলার জন্য মূলত যারা কুচক্রী মহল, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, ধর্ম নিয়ে যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করে, সামাজিক বিভাজনের সীমানাতেই তারা কিন্তু আঘাত করে। ’’
তিনি মনে করছেন এভাবেই শিয়া সুন্নি বিভাজনে তারা আঘাত করেছে, হিন্দু মুসলমান বিভাজনে তারাই আঘাত করে – এবং উগ্রবাদী ইসলামের চর্চ্চা করতে চায়। তার কথায় জনগণের ভেতরে এসব ব্যাপারে কোনো বিরোধ নেই।
‘‘আমি এটাকে একটা নাশকতা বলব- তারা নাশকতা চালিয়েছে যাতে এই সম্প্রীতির জায়গাটা ভাঙ্গা যায়।’’
সাইট নামে ওয়েবভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান যারা আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠিগুলোর তৎপরতার ওপর নজর রাখে তারা বলছে শনিবার বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠি। এর আগে সাইট জানিয়েছিল বাংলাদেশে বিদেশিদের হত্যার দায়ও ইসলামিক স্টেট স্বীকার করেছিল।
ডঃ আলী রীয়াজ বলছেন সাইট আন্তর্জাতিক জঙ্গী তৎপরতা সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে যেসব তথ্য দিয়েছে তার কিছু কিছু অতীতে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় বাংলাদেশে এসব ঘটনার সঙ্গে আইএসের জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়ে একক একটি সূত্রের ওপর নির্ভর করার পক্ষপাতী তিনি নন।
তিনি মনে করেন না যে বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট বা একিউআইএস-এর সাংগঠনিক উপস্থিতি আছে। তেমন কোনো তথ্য বা প্রমাণ না থাকলেও তিনি বলছেন ‘‘একিউআইএস বা আইএস-এ যোগদানে ইচ্ছুক বা আকাঙ্ক্ষী জঙ্গী বা সন্ত্রাসী বাংলাদেশে থাকাটা বিচিত্র নয়- সেটা আছে বাংলাদেশে।’’
তিনি বলেন বিভিন্ন সময়ে এধরনের সংগঠনের প্রতি কিছু মানুষের আকর্ষণের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশে স্থানীয় জঙ্গী সংগঠন আছে যাদের কিছু কিছুর আঞ্চলিক পর্যায়ে যোগাযোগের তথ্যও রয়েছে। কাজেই এদের উপস্থিতিএবং আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠিগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।ডঃ রীয়াজ আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন অদূর ভবিষ্যতে সাংগঠনিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলেও অবাক হওয়ার মত কিছু থাকবে না, কারণ স্থানীয় গোষ্ঠিগুলো সাধারণত সুযোগের অপেক্ষাতে থাকে।
মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত আবদুর রশিদও মনে করেন ‘‘বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোর জন্ম ও বৃদ্ধি দেশজ এবং তারা বাংলাদেশের ভেতর যেসব আক্রমণ চালিয়েছে তা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার জন্যই করেছে।’’
‘‘একিউআইএস বা আইএস-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো গোষ্ঠির উপস্থিতি আমরা এখনও বাংলাদেশে পাই নি, তবে আদর্শিক যোগাযোগের বিষয়টি রয়েছে।’’
তিনি দৃঢ়ভাবে মনে করেন আদর্শগতভাবে এধরনের অনেক জঙ্গী খেলাফত প্রতিষ্ঠার বাসনা নিজেদের মনে লালন করলেও বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা মূলত আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই।
‘‘এদের পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অনেক প্রমাণই আমরা পেয়েছি।’’
ডঃ রীয়াজ মনে করছেন এসব ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির যোগাযোগ রয়েছে এবং মূলধারার রাজনীতি চর্চ্চার সুযোগ বিস্তৃত হলে, সবাই কথা বলার সমান সুযোগ পেলে এধরনের হামলা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।