বাবুু খান. মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর বালিকা বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষ। ২১ জন ছেলেমেয়েকে দেখা যাচ্ছে ১৫টি কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু একটা করতে। কম্পিউটারের মনিটরটির দিকে ভালোমতো খেয়াল কররে বোঝা যায় এগুলো একটু অন্য রকম। কারণ, এই মনিটরের চারদিকের কাঠামোটা কাঠের!
কাঠামোটা বানানো হয়েছে ঢাকায়। শমশেরনগরের আগে ঢাকার ধানমন্ডি সরকারি বালক বিদ্যালয়ে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে ১৫ জন শিক্ষার্থীর। তারা সবাই বাংলা পাই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা একটি স্বল্পমূল্যের কম্পিউটার ব্যবহার করছিল। এ কম্পিউটারেই ঢাকার পাঁচ দিনের এক কর্মশালায় তারা পাইথন প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি নিয়েছে। পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন সাধারণ কাজ। শমশেরনগরেও কম্পিউটারের সাধারণ ব্যবহার শেখানোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি মিডিয়া ল্যাবে উদ্ভাবিত ছবিভিত্তিক প্রোগ্রামিং ভাষা স্ক্র্যাচের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা দেওয়া হয়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত ও কম্পিউটার কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের পক্ষে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী তারিক আদনান এ প্রকল্পের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্বল্পমূল্যের কম্পিউটার বানানোর চেষ্টা করছেন। বাংলা পাই কম্পিউটারে প্রাথমিকভাবে রাস্পবেরি পাই নামের একটি তিন হাজার টাকা দামের মাদারবোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে।
তারিক আদনান জানান, ‘হার্ভার্ডে গত সেমিস্টারে রাস্পবেরি পাই নিয়ে কাজ করার সময় আমার মনে হয়েছে, এটা দিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যের কম্পিউটার বানানো সম্ভব। এই বোর্ডটিতে ৯০০ মেগাহার্টজ গতির প্রসেসর এবং ৫১২ মেগাবাইট র্যাম আছে। পাশাপাশি ৪টি ইউএসবি পোর্ট, ল্যান ও অডিওভিডিও আউটপুট আছে। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক প্রয়োজনীয় সবকিছুই এতে করা সম্ভব। ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়াও যাবে।’
কাজ শুরু করেন তারিক আদনান। তাঁকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় হার্ভার্ড সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট। তারিকের নমুনা বা প্রোটোটাইপটা কেমন কাজ করে তা হাতে-কলমে পরীক্ষা করার জন্য শীতের ছুটিতে দেশে আসেন তারিক। ঢাকা আর মৌলভীবাজারের কর্মশালা দুটি সেই কার্যক্রমেরই অংশ।
তবে কাজটা নেহাত সোজা নয়। প্রথমে ফটোফ্রেমের কারিগরদের দিয়ে এ কম্পিউটারের জন্য ফ্রেম বানানো হয়েছে। জোগাড় করা হয়েছে ১০.১ ইঞ্চি এলসিডি প্যানেল। কি-বোর্ড আর মাউস তো আছেই। আপাতত ১৫টি কম্পিউটার একটি পাওয়ার সাপ্লাই দিয়ে চালানো হয়েছে। তবে প্রতিটির জন্য আলাদা পাওয়ার সাপ্লাইয়ের নকশাও তৈর করা আছে।
অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বিনা মূল্যের লিনাক্স। এতে রয়েছে লেখালেখির সফটওয়্যার, প্রোগ্রামিং শেখার স্ক্র্যাচ সিস্টেম, পাইথনের কম্পাইলার, গান ও ভিডিও চালানোর সফটওয়্যার, বেশ কযেকটি গেমস এবং ওয়েবসাইট দেখার সফটওয়্যারসহ নানা কিছু।
একজন স্কুলশিক্ষার্থী তার প্রায় সব প্রয়োজনীয় কম্পিউটারের কাজ বাংলা পাই দিয়ে করতে পারবে। তিনি বললেন, ‘এই পুরো কম্পিউটার ব্যবস্থা তৈরি করতে খরচ হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ২০০ টাকা! পাইলট প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ও বেশি পরিমাণ বানানো হলে এই খরচ আরও কমিয়ে আনা সম্ভব।’ প্রতিটি কম্পিউটার মাত্র পাঁচ ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করে।
ঢাকার অগ্রসর এবং মৌলভীবাজারের কিছুটা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচালিত কর্মশালাগুলোর অভিজ্ঞতাও বেশ ভালো বলে জানালেন তারিক আদনান। দুই জায়গাতেই শিক্ষার্থীরা সহজে এটি চালানোর কৌশল খুঁজে পেয়েছে। তারা আরও একটু বড় আকারের মনিটর চেয়েছে। তারিক আদনান বলেন, তবে সব শিক্ষার্থীই প্রোগ্রামিং শেখার স্ক্র্যাচ আনন্দের সঙ্গে ব্যবহার করছে।
বাংলা পাইকে আরও উন্নত করবেন বলে জানালেন তারিক আদনান। বিশেষ করে একেবারে বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী নতুন মাদারবোর্ড বানিয়ে সেটি দিয়েই কাজটি করা যাবে। তবে তার জন্য দরকার সবার সহযোগিতা।