বাংলাদেশী টাকায় ফিলিপিনো ক্যাসিনোতে ফূর্তি-নায়কদের মুখোশ উম্মোচন করলো ইনকোয়েরার
লাবণ্য চৌধুরী : বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ চুরির নেপথ্য নায়কদের মুখোশ উম্মোচন করেছে ফিলিপাইনের পত্রিকা ইনকোয়েরার। এই পত্রিকাটিই বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা প্রথম প্রকাশ করেছিল। বুধবার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আরেকটি সংবাদ প্রকাশ করেছে তারা। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশী টাকায় ফিলিপিনো ক্যাসিনোতে ফূর্তি করে দলের নায়ংক ফের ওই টাকা হংকং পাচার করে দেয়। এই নায়কদের’ই মুখোশ উম্মোচন করলো ইনকোয়েরার ।
রিপোর্টে বলা হয়, ফিলিপাইনের ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও ৮৭ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা) পাচারের চেষ্টা আটকে দেওয়া হয়। গত মাসে হওয়া এই চুরির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর কয়েকটি বহুজাতিক ব্যাংকের অনুরোধে এ পদক্ষেপ নিয়েছে ফিলিপাইন।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যেভাবে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরির পর ফিলিপাইন দিয়ে পাচার করা হয়েছিল, এই অর্থও একইভাবে পাচারের চেষ্টা হয়েছিল। রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই অর্থ ফিলিপাইনে এসেছিল। চুরি হওয়া সেই অর্থ স্থানীয় মালিকের মাধ্যমে আবার বিদেশে পাচার করা হয়।
বিভিন্ন সূত্র ইনকোয়েরারকে জানিয়েছে, স্থানীয় মুদ্রায় পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৭০ কোটি পেসো। রিজাল ব্যাংকের মাধ্যমে এই অর্থ প্রথমে যায় একটি বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। এরপর তা যায় সোলাইরি রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি অব ড্রিমস ও মাইডাস নামের তিনটি ক্যাসিনোর কাছে। ক্যাসিনোগুলো প্রথমে এই অর্থ জুয়ার টেবিলে ব্যবহার হওয়া চিপসে রূপান্তর করে।
এরপর তা আবার অর্থে রূপান্তর করে পাচার করা হয় হংকংয়ে। তদন্তকারী সংস্থার মতে, টাকার অঙ্কে এখন পর্যন্ত ফিলিপাইনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থ পাচারের ঘটনা এটি।
রিজাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সব জানত: ফিলিপাইনের মাকাতি শহরের রিজাল ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে পাচার হওয়া এ অর্থের লেনদেনের বিষয়ে ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই সব জানত। ব্যাংকটির সিংহভাগ শেয়ারের মালিক ফিলিপাইনের ইয়ুশেংকো পরিবার।
চলমান তদন্তের কারণে সাময়িক নিষেধাজ্ঞায় থাকা রিজাল ব্যাংকের মাকাতি শাখা ব্যবস্থাপকের এক মুখপাত্র ইনকোয়েরারকে জানান, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সঠিক যাচাই-বাছাই ছাড়াই ২০১৫ সালের মে মাসে খোলা পাঁচটি হিসাবের মাধ্যমে চুরি হওয়া অর্থের লেনদেন করা হয়। যেসব পরিচয়পত্র দিয়ে ওই হিসাবগুলো খোলা হয়েছিল, তার প্রতিটির সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
শাখা ব্যবস্থাপকের মুখপাত্র বলেন, ‘অনিয়মের সব দায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এখন তাঁর ঘাড়ে চাপাবে এমন ভয়ে আছেন তিনি। কিন্তু এই কাজটি করতে ব্যাংকের উচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল, তাদের নির্দেশের বাইরে গিয়ে তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না।’
মার্কিন ব্যাংকের সম্পৃক্ততা: ইনকোয়েরার-এর হাতে আসা নথিপত্র অনুযায়ী, ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্স হিসেবে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে আসে ৫ ফেব্রুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটি ব্যাংক ও ওয়েলস ফারগো ব্যাংকের মাধ্যমে রিজাল ব্যাংকে অর্থ পাঠানো হয়। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের আন্তর্জাতিক সংকেত (সুইফট কোড) ব্যবহার করে ফিলিপাইনের ব্যাংকে তহবিল স্থানান্তরের বার্তাও পাঠায় মার্কিন ব্যাংকগুলো।
ব্যবসায়ী ও ক্যাসিনোর ভূমিকা: চুরি হওয়া এই অর্থ রিজাল ব্যাংকের ওই পাঁচটি আলাদা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে একটি বড় করপোরেট হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ওই অর্থ ফিলিপাইনের নিজস্ব মুদ্রা পেসোতে রূপান্তর করে ফিলরেম নামের একটি বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান।
ওই বড় করপোরেট হিসাবটি একজন সন্দেহভাজন চীনা-ফিলিপিনো ব্যবসায়ীর। ফিলরেমের মাধ্যমে তিনটি ক্যাসিনো হয়ে ওই অর্থ আবার রিজাল ব্যাংকের কাছে আসে। এরপর ওই সন্দেহভাজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে অর্থ হংকংয়ে পাচার করা হয়।
ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা: অর্থ পাচারের এ ঘটনা ঠেকাতে ফিলিপাইনের অর্থ ব্যবস্থাপনার ঘাটতির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ইনকোয়েরারকে জানান, ‘ক্যাসিনোগুলো এই পাচারে যুক্ত থাকলেও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। তা না হলে এত বড় জালিয়াতি করা সম্ভব হতো না।’ তবে সময়মতো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় ৮৭ কোটি ডলারের জালিয়াতি ঠেকানো গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগাযোগ: বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ফিলিপাইনে এসে ব্যাংকো সেন্ট্রাল এনজি ফিলিপিনাসের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। এদিকে রিজাল ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘কমলা তালিকাভুক্ত’ হওয়ার আতঙ্কে আছেন।
গ্রাহকের তথ্য সঠিকভাবে যাচাই না করার অপরাধে তাঁর এ শাস্তি হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ও ফিলিপাইন অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড গেমিং করপোরেশন (প্যাগকর) আলাদা তদন্ত করছে। নিজস্ব ক্যাসিনো চালানোর পাশাপাশি প্যাগকর ফিলিপাইনে ক্যাসিনো পরিচালনার নিবন্ধন দিয়ে থাকে।