বাংলাদেশকে আমরা ‘দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তুলছি-হাসিনা
ভয়েস অব আমেরিকা অবলম্বনে আসমা খন্দকার : বাংলাদেশকে আমরা ‘দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তুলছি। বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি, শিক্ষা ব্যবস্থা -চিকিৎসা ব্যবস্থা- নিশ্চিত করে গৃহহীন মানুষকে ঘর’ও আমরা করে দিচ্ছি। আমাদের এসব কার্যক্রমে ইর্ষাম্বিত হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র-জামাত শিবির ও তাদের দোসররা।আওয়ামী লীগ ‘বিরাজনীতিকরণের’ পথে হাঁটছে বলে বিএনপির অভিযাগ নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতির ‘যথেষ্ট সুযোগ’ আছে, এবং এ নিয়ে কোনো ‘সন্দেহ নেই’।
ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কথা তো কারও কাছ থেকে আমরা কেড়ে নিচ্ছি না। যার যার ইচ্ছা মত কথা বলেই যাচ্ছে। তারা মিটিং করছে, র্যালি করছে, সবই তারা করছে।দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না এলেও সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ওই অভিযোগের ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বলেছেন, তারাতো রাজনীতি ঠিকই করছে।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন শেষে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারটি ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের ওয়েবসাইটে অডিও আকারে প্রকাশ করা হয়েছে শনিবার।সেখান থেকে জাতিরকন্ঠের পাঠকদের জন্যে এখানে তা তুলে ধরা হলো:
সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন শেখ হাসিনা।তিনি বলেছেন জনগণকে সচেতন করে জঙ্গিবাদ দমনে সম্পৃক্ত করার কথা’ও।যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময় যারা এই যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছিল, তাদেরও বিচার হওয়া উচিৎ।
ভয়েস অব আমেরিকা: এক নাগাড়ে প্রায় সাড়ে সাত বছর দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই পর্বে আপনার সাফল্যগুলো কীভাবে দেখেন।
শেখ হাসিনা: আমাদের যে লক্ষ্যটা, বাংলাদেশকে আমরা ‘দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তুলব, আর্থ-সামাজিক উন্নতি করব। সেদিক থেকে ব্যাপক সাফল্য আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। সব সময় আমাদের একটাই প্রচেষ্টা ছিল, কীভাবে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করব, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করব, শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করব, চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করব, গৃহহীন মানুষকে ঘর দেব… অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা- এই যে মৌলিক চাহিদাগুলি, এগুলো পূরণ করা।
আমি এইটুকু অন্তত দাবি করতে পারি, আমাদের এই সাড়ে সাত বছরের মধ্যে আমরা বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার কমিয়ে এখন ২২ দশমিক ৪ ভাগে নিয়ে এসেছি। প্রত্যেক মানুষের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলারে আমরা উন্নীত করতে পেরেছি। আমাদের বাজেট আমরা বৃদ্ধি করেছি। প্রায় তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেট আমরা ঘোষণা দিয়েছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা সর্ববৃহৎ বাজেট।
বিশাল কর্মযজ্ঞ আমরা শুরু করেছি। মানুষের চিকিৎসা সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছি। বিনা পয়সায় আমরা প্রায় ৩০ প্রকার ওষুধ দিচ্ছি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে। সমগ্র বাংলাদেশে প্রায় ১৬ হাজার এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে। সেই সাথে বিশেষায়িত হাসপাতাল আমরা করেছি।
প্রায় প্রতি জেলায় যাতে বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তার ব্যবস্থা করেছি। বিনা পয়সায় বই দিচ্ছি। আমরা ছেলেমেয়েদের বৃত্তি দিচ্ছি। এখন আমরা উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি দিয়ে যাচ্ছি।
সাফল্যের ইতিহাস তুলে ধরতে গেলে তো… এতো ব্যাপক…. যে এতো অল্প সময়ে শেষ করা যাবে না। তবে একটা বিষয় আপনারা লক্ষ্য করবেন যে বাংলাদেশের মানুষের ভিতরে একটা আস্থা বিশ্বাস ফিরে এসেছে। এবং মানুষের যে আর্থিক চরম দৈন্যতা ছিল- সেটা এখন অনেকটা কমে যাচ্ছে। কারণ পাঁচ কোটি মানুষ কিন্তু এখন নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে এসেছে।
এখনও যারা হতদরিদ্র বা দারিদ্র্য সীমার নিচে বা যারা একটু কষ্টে আছে, তাদের কষ্ট দূর করার জন্য আমরা কতগুলি পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন ইতোমধ্যে ১০ টাকায় একজন মানুষ যেন ৩০ কেজি করে চাল কিনতে পারে, তার ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। ৫০ লক্ষ মানুষ এই সুযোগটা পাবে।
যে সময়টায় আমরা সরকার গঠন করি, তখন সারা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ছিল। এই মন্দার অবস্থাতেই কিন্তু আমাদের কাজ করতে হয়। সেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি আমরা প্রায় পাঁচ বছর ছয় ভাগের ওপরে ধরে রেখেছি। এবারে আমরা সাত ভাগে চলে এসেছি। মূল্যস্ফীতি কম, প্রবৃদ্ধি বেশি, এর সুফলটা সাধারণ মানুষ পাচ্ছে, গ্রামের মানুষ পাচ্ছে।
এই যে বিপুল সাফল্য, বিশেষ করে মানবন্নোয়নের ক্ষেত্রে আপনার সরকারের তুলনাহীন সাফল্য, এর পেছনে কী রহস্য কাজ করেছে? এতোদিন হয়নি, এখন কেন হচ্ছে?
কেন হচ্ছে… আমি একটি কথা আপনাদের মনে করাতে চাই, যে দল একটা দেশের জন্য, জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, সংগ্রাম করে, আন্দোলন করে, বিপ্লব করে এবং যুদ্ধ করে বিজয় এনে দেয়, সেই দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখনই কিন্তু দেশের উন্নতি হয়। কাজেই আমরা যেটা করি, আমাদের একটা অন্তরের টান থেকে কাজ করি। এখানে আর কোনো ম্যাজিক না। ম্যাজিক একটাই, আমরা জনগণের কল্যাণে দেশের স্বাধীনতা এনেছি, জনগণের কল্যাণ করাটাই আমরা মনে করি আমাদের কর্তব্য।
কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হতে হয় আপনাকে?
অনেক, অনেক রকম চ্যালেঞ্জ। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা- সেটা একটা চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ… যারা এই যে উড়ে এসে ক্ষমতায় জুড়ে বসেছিল, বা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে তাদের দল গঠন করে রেখে গেছে, তারা তো ক্ষমতার লোভটা ছাড়তে পারে না। তাদের যে হত্যাযজ্ঞ চালানো, মানুষ পোড়ানো, অগ্নি সন্ত্রাস, মানুষের ক্ষতি করা, নির্বাচন যাতে না হয়- তার জন্য বাধা দেওয়া, নানা ধরনের কর্মকাণ্ড করে সমস্যা তারা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসকে তারা উসকে দেয়। কাজেই এই ধরনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হয়।
তবে আমি সব সময় মনে করি জনগণই শক্তি, যে কোনো চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, অন্তত তার মোকাবিলা করবার মত সেই শক্তি, ক্ষমতা আমাদের আছে। যেহেতু আমি জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করি।
একটা বড় চ্যালেঞ্জ এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী, যেটা আপনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে উগ্র জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ। এই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রে আপনার সরকারের কী ধরনের পরিকল্পনা আছে, বিশেষ করে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার একটা প্রশ্ন নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করবেন?
আমরা যেটা করতে সক্ষম হয়েছি, সেটা হচ্ছে জন-সম্পৃক্ততা বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। যেমন অভিভাবক, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, আমাদের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ, আমাদের ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধি, সকল শ্রেণির মানুষকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছি। প্রত্যেকে এখন জঙ্গিবাদবিরোধী ভূমিকা নিচ্ছে। এই যে জনগণের সম্পৃক্ততা, এটাই হচ্ছে মূল শক্তি। আর অন্যান্য দেশ… তাদের সাথে আমাদের যে আলোচনা হচ্ছে, যেমন টেকনিক্যাল সাপোর্টগুলি নেওয়া, ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি- সে বিষয়টা। কিন্তু যতোই যা হোক না কেন, আমি মনে করি, আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা, তারা যেমন তৎপর, সাথে সাথে দেশবাসী এখন সচেতন। তারাই খবর দিচ্ছে, তারাই প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, কাজেই তাদেরকে সম্পৃক্ত করে… একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে নিয়ে সর্বস্তরে আমরা তাদের সম্পৃক্ত করেই কিন্তু এটা মোকাবিলা করে যাচ্ছি।
এবং আপনি জানেন, বাংলাদেশ কিন্তু একটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই যে পহেলা জুলাই যে ঘটনাটা ঘটল, মাত্র ১০ ঘণ্টার মধ্যে আমরা জিম্মি উদ্ধার করেছি, এবং এই সন্ত্রাসীদের আমরা নির্মূল করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছি। আমি মনে করি, যে কোনো চ্যালেঞ্জ এলে আমরা তা মোকাবিলা করতে পারি।
কেউ কেউ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে মাত্রায় হয়েছে, রাজনৈতিক স্পেসটা, জায়গাটা অনেকেই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ ওঠে, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিশেষ করে।
কথা হচ্ছে একটা রাজনৈতিক দল যদি সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে, তো সেই রাজনৈতিক দলকে তার খেসারত দিতে হবে। আমরা নির্বাচন করেছি, বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে আসেনি। তারা নির্বাচন ঠেকাতে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে। তাদের কি এখন মানুষ পোড়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে? আমার সেটাই প্রশ্ন।
বাংলাদেশে আপনারা জানেন যে একটা মাত্র টেলিভিশন ছিল বিটিভি। আমাদের সময়ে আমরা… এখন প্রাইভেট সেক্টরে যথেষ্ট টেলিভিশন রয়েছে। এবং যার যত ইচ্ছা কথা বলতে পারে। তারা ন্যাশনাল ইলেকশনে অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু তারা লোকাল গভার্নমেন্ট ইলেকশনে তো অংশগ্রহণ করেছে। তাহলে বলবেন কি করে যে তাদেরকে স্পেস দেওয়া হয় না?
কথা তো কারও কাছ থেকে আমরা কেড়ে নিচ্ছি না। যার যার ইচ্ছা মত কথা বলেই যাচ্ছে। তারা মিটিং করছে, র্যালি করছে, সবই তারা করছে। রাজনীতির যথেষ্ট সুযোগ আছে, এতে কোনো সন্দেহ নাই।আপনার সরকারের একটি বিরাট সাফল্য হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, সেজন্য অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
অবশ্যই এটা আমাদের দায়িত্ব ছিল, জাতীয় দায়িত্ব, জাতির কাছে আমরা ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বিচার শুরু করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সেই বিচার বন্ধ করে সমস্ত অপরাধীদেরকে সে মুক্ত করে দেয়। ১১ হাজার সাজাপ্রাপ্ত ছিল; ২২ হাজার মামলা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান এসে সব বন্ধ করে দিয়েছিল।
আমরা জাতির কাছে ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম, আবার আমরা সরকারে এসে সেই বিচার করেছি।কত দুর্ভাগ্য আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন। যে বিরোধীদলের কথা আপনি একটু আগে বললেন, তারা স্পেস চায়, তারা তো এই সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী করেছিল। আমার লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা এদের হাতে তুলে দিয়েছিল।কাজেই এই যে যুদ্ধাপরাধীদের যারা আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছে, মন্ত্রী বানিয়েছে, তাদেরও তো বিচার হওয়া উচিৎ।