বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে খুন হতোনা যদি-
আবেদ খান : শাহাদত চৌধুরী, সাপ্তাহিক বিচিত্রার। সে তখনো সম্পাদক হয়নি, তবে মোটামুটিভাবে বিচিত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। শাহাদত আমাকে বলল, “তোকে একটা বোম ফাটানো ‘ওপেন সিক্রেট’ লেখার মসলা দিতে পারি। সাহস করে লিখতে পারবি?”
….গাড়ি এল কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটায়। স্টিয়ারিংয়ে একহারা সুদর্শন সুবেশী এক যুবক। একটানে গাড়ি নিয়ে গেল দৈনিক বাংলার নিচে। শাহাদত নেমে এল। আমাদের নিয়ে গাড়ি চলল বাংলা মোটরের দিকে। আমরা কেউ কথা বলছি না, যেন এক রহস্যময় অভিযানে যাচ্ছি। আমি জানি না গাড়ি কোথায় যাচ্ছে। যুবকটি গাড়িটা নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টের ভেতর। তখন ক্যান্টনমেন্ট এখনকার মতো এত ইমারতে ঠাসা ছিল না।
আর ক্যান্টনমেন্ট সম্পর্কে আমারও তেমন কোনো ধারণা ছিল না। বলতে পারব না কোন পথ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি বাংলো ধরনের বাড়িতে। তখন বিকেল সাড়ে ৪টা হবে। মনে হলো শাহাদত বাড়িটা চেনে এবং সম্ভবত গৃহকর্তাকেও। কারণ আমরা যখন বাংলোর লনে রাখা চেয়ারে বসলাম, তখন সুন্দরী গৃহকর্ত্রী এলেন হাসিমুখে। শাহাদত তাঁর নাম ধরে সম্বোধন করল এবং আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল মেজর ডালিমের স্ত্রী নিম্মি বলে।
প্রসঙ্গটা ওঠাল শাহাদতই। বেইলি রোডের লেডিজ ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক বিয়ের অনুষ্ঠানে কিভাবে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল, তারই সবিস্তার বিবরণ। বোধ হয় শাহাদতের ইচ্ছা ছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি ইত্তেফাকে একটা রিপোর্ট লিখি। কিংবা হতে পারে ইচ্ছাটা ছিল অন্য কারো, যা প্রকাশিত হয়েছে শাহাদতের মাধ্যমে। আমরা যখন লনে কথা বলছিলাম, তখন বাংলোর একটি কক্ষ থেকে ছয়-সাতজন তরুণ সেনা কর্মকর্তাকে বের হতে দেখলাম।
শাহাদত তাদের একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল, মেজর ডালিম। শ্যামলা, সুদর্শন। মেজর ডালিম তার বন্ধুদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল। তাদের মধ্যে তিন-চারজনের নাম লিখে রেখেছিলাম পরে আমার রিপোর্টে। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ, মেজর নূর, কর্নেল শাহরিয়ার। পরে শাহাদতের কাছ থেকে জেনেছি, ঘাতকচক্রের আরো কয়েকজন ছিল এবং ওখানে ওদের গোপন বৈঠক হচ্ছিল।
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর কর্নেল ফারুককে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল এবং তার কথাবার্তাও ছিল বল্গাহীন। রশীদকে মনে হচ্ছিল শান্ত, স্বল্পভাষী এবং নীরব পর্যবেক্ষণকারী। মেজর নূরকে দেখলাম, নিস্পৃহভাবে একটা কাঠি দিয়ে পাঁচিলের একটা গর্ত খোঁচাচ্ছে। মেজর ডালিম আমাকে বারবার অনুরোধ করছিল লেডিজ ক্লাবের ঘটনাটা লেখার জন্য।
ওদিকে কর্নেল ফারুক সক্রোধে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিষোদ্গার করছিল এবং কর্কশকণ্ঠে আমাকে বলছিল, ‘ইউ উইল সি, দেয়ার ইউল বি আ ন্যাশনাল ইস্যু ভেরি সুন।’ (তুমি দেখো, শিগগিরই একটা জাতীয় ইস্যু তৈরি হবে।) যতই আমার বন্ধু শাহাদত, মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী আমাকে লেডিজ ক্লাবের ঘটনা নিয়ে লেখার জন্য পীড়াপীড়ি করুক না কেন, আমার মস্তিষ্কের গভীরে তখন ‘ওপেন সিক্রেট’-এ এক বিপজ্জনক প্রতিবেদন দানা বাঁধছে।
……..সন্ধ্যায় আমি ফিরলাম আমার অফিসে। শাহাদত হাটখোলায় তার বাড়িতে। পথে শাহাদত জিজ্ঞেস করল, ‘স্টোরিটা কেমন বলে মনে হয়?’ বললাম, ‘দারুণ!’ শাহাদত বলল, ‘তুই ভালো বুঝিস কী লিখবি, কিভাবে লিখবি!’ অফিসে ফিরে লিখলাম রিপোর্ট_লেডিজ ক্লাবের ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ তাতে নেই_আছে কিছুসংখ্যক তরুণ সেনা কর্মকর্তার গোপন বৈঠক এবং ক্ষোভের বিস্তারিত বিবরণ আর আসন্ন বিপর্যয়ের আভাস। শিরোনাম ছিল ‘তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক’ শোল্ডার হেডিং এবং মূল হেডিং ‘সেনা বিদ্রোহের আশঙ্কা’।
রাতে লেখাটা সরাসরি প্রেসে পাঠিয়ে দিয়ে চলে গেলাম বাড়িতে। তখন বার্তা সম্পাদক মরহুম আসফউদ্দৌলা রেজা। আমার লেখার ওপর তাঁর এতখানি আস্থা ছিল যে তিনি স্ক্রিপ্ট দেখতে চাইতেন না। আমি বাসায় ফিরে ভাবছি একটা দারুণ চাঞ্চল্যকর ‘ওপেন সিক্রেট’ ছাপা হবে পরদিন। কিন্তু দেখলাম, পরদিন রিপোর্টটা ছাপা হয়নি। রেজা ভাই টেলিফোনে জানালেন, চিফ ফোরম্যান খন্দকার বজলুর রহমান আমার লেখা নিয়ে রেজা ভাইকে দিয়ে বলেছিলেন, “রেজা সাহেব, এই ‘ওপেন সিক্রেট’টা নিয়ে ছোট সাহেবের (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) সঙ্গে কথা বলেন।”
রেজা ভাইয়ের কাছ থেকে বিষয়টি শুনে সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু লেখাটি না ছাপানোর নির্দেশ দেন এবং আমাকে বলা হয়, আমি যেন ‘ওপেন সিক্রেট’ সিরিজটি বন্ধ করে দিই।….অবশেষে ঘটেই গেল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট।
সেদিন যদি আমার ওই রিপোর্টটা প্রকাশিত হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস এত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ দ্বারা মসিলিপ্ত হতো না।