বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ে গর্জেছিল তাঁর ক্যামেরা ফ্ল্যাশ
শফিক রহমান : বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ক্যামেরা ফ্ল্যাশ। তাঁর কাজ কর্মে খুশী হয়ে বঙ্গবন্ধু’ও তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন দামি ক্যামেরা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ে তুমি চালিয়ে যাও তোমার ক্যামেরা ফ্লাশ। এরপর বঙ্গবন্ধুর দেয়া দেয়া ক্যামেরায় একের পর ঐতিহাসিক ছবি তুলেছেন তিনি। সেই ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান এখনও যেন জীবন্ত কিংবদন্তী।
বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধুর সেই সৈনিক এর মূল্যায়ন এখন সময়ের প্রশ্ন? জাতির বিবেকের প্রশ্ন? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের প্রশ্ন? জাতির জনকের কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কাছে জাতিরকন্ঠ এর প্রশ্ন ফটোগ্রাফার লুৎফরের মূল্যায়ন করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!
যে লুৎফরের ক্যামেরার ফ্লাশ জলেছিল ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ১৯৭১ এর ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান, ৭২ এ বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার ছবি দিয়ে। এমনি জাতির জনকের নানা দুর্লভ ঐতিহাসিক মূহুর্তের ছবির নেপথ্য নায়ক ছিলেন লুৎফর রহমান।
১৯৫৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাজশাহী সফরে এসে প্রথম বারের মত লুৎফর রহমান এর ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী হন।এভাবেই বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের একেকটি কালজয়ী মূহুর্ত গুলো চিত্রিত করতে থাকেন এই গুনী শিল্পী, বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন,সংগ্রামে গর্জে উঠেছে তার ক্যামেরা ফ্লাশ।
এই গুনী শিল্পী ফটোসাংবাদিক এর ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু (যিনিও একজন ফটো সাংবাদিক) জানান, সময়টা ছিল ব্রিটিশ ভারতের শেষের দিকে রয়াল এয়ারফোর্সে ছোট একটা চাকুরীর সুবাদে একদিন এক বৈমানিক বলল, তোমার ধুতি পাঞ্জাবিটা পরে একটা ছবি তুলতে চাই, আর ছবিটা তুলবে তুমি বলে, তার ১২৭ বেবী ব্রাউনি ক্যামেরাটা তুলে দিল ১৬ বছরের এক উদ্দাম যুবকের হাতে! কোন ইংরেজ সাহেবকে সরাসরি না বলার দঃসাহস কোন বাঙ্গালীর ছিলনা অথচ দৃঢ় চেতা যুবকটি বিনয়ের সাথে বলল “আমি আমার ধুতি পাঞ্জাবী দিতে পারি কিন্তু ক্যামেরা চালাতে জানিনা। বৈমানিক তাকে ক্যামেরা চালানের কৌশল শিখিয়ে দিলেন।
যুবকটি আত্মবিশ্বাসের সাথে চমৎকার ছবি তুলল। তখনকার এনালগ ক্যামেরায় সাদা কালো ছবি তোলার জন্য ক্রিটিক্যাল শার্পনেস ও ভালো কম্পোজিশন ছিল অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু প্রথম ক্যামেরা হাতে মোঃ লুৎফর রহমান কে অপরিচিত কিংবা আনকোরা ফটোগ্রাফার মনে হয়নি যার প্রমান তার কাজের মুন্সীযানায় তিনি দিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি ফটোগ্রাফিক নিজের ধ্যান ও জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্থানে ধারণ করে কিনে ফেলেন ১২০ আগফা বক্স ক্যামেরা। এসময় তিনি রাজশাহী শহরে অবস্থান করেন এবং একই সাথে স্টুডিও ফটোগ্রাফি ও প্রেস ফটো কাভারেজের কাজ করে প্রশংসিত হন। অসহায় গরীব ছাত্রদের কাছ থেকে তিনি ছবির বিনিময়ে কোন পয়সা নিতেন না।
রাজশাহী শহরে কিবা উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বড় কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সভা হলেই ডাক পড়তো লুৎফর রহমানের। ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই তিনি রাজশাহীর বিশিষ্ঠ নাগরিকদের সান্নিধ্যে আসেন। তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। উত্তর বঙ্গের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের প্রতিষ্ঠাকালিন দূর্লভ সব ছবির কারিগর ছিলেন এই প্রতিথযশা আলোকচিত্র শিল্পী।
১৯৫৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাজশাহী সফরে এসে প্রথম বারের মত লুৎফর রহমান এর ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী হন।এভাবেই বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের একেকটি কালজয়ী মহুর্ত গুলো চিত্রিত করতে থাকেন এই গুনী শিল্পী, বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন,সংগ্রামে গর্জে উঠেছে তার ক্যামেরা ফ্লাশ।
ছয়দফা আন্দোলনের পর লুৎফর রহমানের ভাবনায় আসে জাতীয় পর্যায়ের সকল ঘটনাকে তিনি চিত্রিত করবেন। এ মানস থেকে তিনি রাজশাহী থেকে ঢাকায় চলে আসেন। বঙ্গবন্ধুর তোলা ছবিগুলো নিয়ে সরাসরি হাজির হন বাঙ্গালীর স্বাধীনতা, স্বকীয়তা রচনার জনক জাতির পিতার সামনে। বঙ্গবন্ধু সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন আর বলেছিলেন চালিয়ে যেতে।
এরপরে চালিয়ে গেলেন লুৎফর রহমান তার ক্যামেরা। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭ই মার্চ ১৯৭১ এ ঐতিহাসিক ভাষন, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান, ৭২ বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা, অনেক দুর্লভ ঐতিহাসিক ছবি তুলে নিজেও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন এই ক্যামেরাম্যান।
১৯৭২ সালে ৫ টাকা ১০ টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংযোজনর জন্য যে চিত্র গ্রহন করা হয়েছিল তাতে লুৎফর রহমান স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবিটি শোভা পাচ্ছে এই মুদ্রাগুলোতে। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাথে অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক সংগঠকদেরও ছবি তুলেছেন এই গুনী শিল্পী। এই মুদ্রাগুলি মিরপুরের ঢাকা জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
১৯৭২ সালের ২৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ইউইলকিনশন কোম্পানির পক্ষ থেকে ইয়াসিকা ম্যাট ১২৪ জি ক্যামেরা তৎকালিন হোটেলে ইন্টার কন্টিনেন্টাল আলোকচিত্রির কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। কোম্পানিটির কর্মকর্র্তাবৃন্দ সে সময় ৫ ও ১০ টাকার এক খন্ডের টাকাও তাকে উপহার দেয়া হয়।
তার সৃষ্টি কর্মগুলো এখনো উজ্জল হয়ে শোভা পাচ্ছে। ৩২ নং ধনিমন্ডিরস্থ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘরে। বাংলাদেশ সচিবালয়ের তথ্য মন্ত্রনালয়ের ব্যালকনিতে। তিনি রেডিও পাকিস্থান এর মুখপাত্র “এলহান ম্যাগাজিনে কাজ করতেন। দেশ স্বাধীনের পরে বাংলাদেশ বেতারের, বেতার বাংলায় তার তোলা অনেক ছবি ছাপা হয়েছে।
সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের অনেক খ্যাতিমান তারকাদের ছবি তুলেছেন এর মধ্যে হেমন্ত মখোপ্যাধ্যায়,রুনা লায়লা মেহেদী হাসান আব্দুল আলিম, ফেরদৌসী রহমান অন্যতম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও অনেক ছবি তুলেছেন এই শিল্পী। শুধু ক্যামেরা হাতেই নয় কলম হাতেও সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কে নিবেদন করে লিখেছেন কবিতা “চিরঞ্জীব”।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু খুশি হয়ে তাকে ম্যাট-১২৪ জি ক্যামেরা উপহার দেন। তার লেখা প্রবন্ধ শতাব্দীর শ্রেষ্ট মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সচিত্র বাংলাদেশ সহ অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
সদা হাস্যোজ্জল, বিনয়ী, সৎ, এই মানুষটি অজীবন দেশের জন্য কাজ করেছেন, নির্লোভ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ছুটে বেরিয়েছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন।
২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন এই শিল্পী। জীবদ্দশায় কখনো কোন অন্যায়,অসত্য ও সুবিধাবাদের সাথে আপোষ করেননি।ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী, এক পুত্র ও তিন কণ্যার জনক ছিলেন। তার সকল সৃষ্টি কর্ম যেন বাংলাদেশের ইতিহাস ও মহাখালীতে তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিচ্ছবি ফটো স্টুডিওটি যেন বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ধারন করা আর্কাইভ।
বঙ্গবন্ধু ইতিহাস তৈরী করেছেন আর তার নির্দেশে ইতিহাসের সচিত্র উপস্থাপনার কারিগর ছিলেন আলোক চিত্রশিল্পী মোঃ লুৎফর রহমান। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই অসাধারন কাজগুলো নতুন মাত্রা এনেছে এবং তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে অনেকে মনে করেন এবং রাষ্টীয় স্বীকৃতীর জন্য তিনি তার উপযুক্ততা প্রমান করেছেন এখন অপেক্ষা স্বীকৃতির এই প্রত্যাশা পরিবারের সদস্যদের।