• শুক্রবার , ২২ নভেম্বর ২০২৪

ফেসবুক আমাদেরই পণ্য আকারে বিক্রি করে দেয়–


প্রকাশিত: ৮:১২ পিএম, ৩১ আগস্ট ১৪ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১১৪ বার

 

 ফাহমিদুল হক :  

ফেসবুকেরও অর্থনীতি আছে, কিন্তু এই কারখানার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে অদ্ভুত এক রীতিতে। এখানেও মালিক-শ্রমিক আছে, তাই শ্রমশোষণও আছে। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প হলো শ্রমশোষণের চূড়ান্ত উদাহরণ; কিন্তু ফেসবুকের শ্রমিকেরা কোনো বেতনই পান না। এরা হলেন এক বিলিয়নের অধিক ফেসবুক ইউজার। তাঁদের তৈরি করা আধেয়ই ফেসবুক-অর্থনীতির মূল ভিত্তি।

অর্থাৎ আমি, আপনি ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিচ্ছি, ছবি শেয়ার করছি, লাইক-কমেন্ট করছি, নোট লিখছি—এসবই ফেসবুক অর্থনীতির প্রাণভোমরা। আমাদের বেতনবিহীন উদ্বৃত্ত শ্রম ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সুকৌশলে বিক্রয়যোগ্য পণ্যে রূপান্তর করেছে। মুশকিল হলো, আমরা এসব করছি সানন্দে এবং ফেসবুকে বসা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ। অজান্তেই যে বিক্রি হচ্ছি, সেই বিষয়ে আমরা সচেতন নই।
ফেসবুক আমাদের তেমন জ্বালাতন করে না, উল্টো দিয়েছে আমার এক নিজস্ব পরিসর। আমার টাইমলাইন, আমার নিজস্ব সব ভাবনার ক্রীড়াক্ষেত্র। ফেসবুকে আমার নিউজফিড ‘বন্ধু’দের কর্মকাণ্ডে ভরপুর, যাদের অনেক কিছুই আমি ‘লাইক’ করি, এবং তারাও আমার অনেক কিছু ‘লাইক’ করে। নতুন নতুন ফিচারের কারণে আমাদের ফেসবুক-জীবন আনন্দ-উত্তেজনাময় হয়ে ওঠে, ‘যার কেউ নেই, তার ফেসবুক আছে।’

বিনিময়ে ফেসবুক কী চায় আমার কাছে?
ফেসবুক সরাসরি কিছু বিক্রি করতে আসে না, কিন্তু খোদ আমাদেরই পণ্য আকারে বিক্রি করে দেয় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে, যা একসময় নির্ভেজাল নেটওয়ার্কিংয়ের জায়গা ছিল, তা এখন পরিণত হয়েছে বিরাট অর্থনীতিতে। ২০০৯ সালে ফেসবুকের নিট আয় ছিল ১২২ মিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে ৩৭২ মিলিয়ন ডলার, ২০১১ সালে ৬৬৮ মিলিয়ন ডলার, আর ২০১৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে।

একই সময়ে দেখা যাচ্ছে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ছিল ১৯৭ মিলিয়ন, ২০১০ সালের মার্চ মাসে ছিল ৪৩১ মিলিয়ন, ২০১১ সালের মার্চ মাসে ছিল ৬৮০ মিলিয়ন, ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে ছিল ৮৪৫ মিলিয়ন এবং ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ছিল ১ দশমিক ০৬ বিলিয়ন।
ফেসবুকের বিপুল পরিমাণ আয়ের উৎস কী? উত্তর,

বিজ্ঞাপন। যত ব্যবহারকারী বেড়েছে, ফেসবুকে বিজ্ঞাপনমূল্যও বেড়েছে। ২০০৯ সালে ফেসবুকের আয়ের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ এসেছিল বিজ্ঞাপন থেকে। ২০১০ সালে তা ছিল ৯৪ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১১ সালে ৮৫ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ৮৪ শতাংশ। আর এখানেই ব্যবহারকারীরা হয়ে পড়েছি, ডালাস স্মাইদের ভাষায়, ‘অডিয়েন্স কমোডিটি’।
অনলাইনে যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁদের বলা হচ্ছে গ্রাহকোৎপাদক (প্রজিউমার), যাঁরা একই সঙ্গে আধেয়র উৎপাদক এবং ভোক্তা। তো এই গ্রাহকোৎপাদকেরা হলেন দ্বিমুখী পণ্যায়নের লক্ষ্যবস্তু। তাঁদের বিপুল সমাবেশের কারণেই বিজ্ঞাপনদাতারা এখানে বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী হয়েছেন এবং তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য থেকে বেরিয়ে আসা তথ্য মোতাবেক, তাঁদের যেসব বিষয়ে আগ্রহ, তার ভিত্তিতেই আবার বিজ্ঞাপনগুলো জায়গামতো পরিবেশিত হচ্ছে।

ফেসবুক-বিজ্ঞাপনের নীড়পাতায় গেলে দেখা যাবে ফেসবুক বলছে, ‘এক বিলিয়নের বেশি মানুষ। আমরা সাহায্য করি যথাযথ মানুষটির কাছে আপনাকে পৌঁছে দিতে।’ অর্থাৎ আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে যেসব তথ্য দিই বা যেসব কর্মকাণ্ড করি, তার ভিত্তিতে ফেসবুক বিজ্ঞাপনদাতাকে সম্ভাব্য ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে দেয়।

ধরা যাক, আপনি গাড়িসংক্রান্ত একটি পেইজ ‘লাইক’ করলেন, অথবা একটা পোস্টে বিশেষ কোনো ব্র্যান্ডের গাড়ির কথা লিখলেন, ফেসবুক আপনাকে ‘সম্ভাব্য কারক্রেতা’ বর্গে ফেলে দেবে এবং কার ব্র্যান্ডটিকে সেই গ্রুপের সদস্যদের টাইমলাইনে বা নিউজফিডে বিজ্ঞাপনটি দিতে সাহায্য করবে। বলা বাহুল্য, আপনি যদি আপনার নিউজফিডে আসা এগুলোর কোনো একটিতে কমেন্ট বা লাইক দেন, তাহলে আপনার বন্ধুদের নিউজফিডে একটা পোস্ট চলে যাবে। এ সবকিছু সম্ভব হয়ে ওঠে, কারণ ফেসবুক সবার সব কার্যকলাপ ও তথ্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ও লিপিবদ্ধ করে এবং এই ডেটাবেইস বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে।

আবার বিজ্ঞাপন প্রকাশের জন্য কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে যথেষ্ট উচ্চহারে অর্থ সংগ্রহ করে। আপনার ফেসবুক-সময় হলো প্রকারান্তরে বিজ্ঞাপন-সময়, ফেসবুকের জন্য যা নিবেদিত।
বাংলাদেশে ফেসবুকের কোনো অফিস নেই। তবে কেউ বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সরাসরি ফেসবুকে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে পারবে। বাংলাদেশে এই সেবা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বা কয়েকজন ব্যক্তি বাকিদের জন্য দিয়ে থাকে।

ফেসবুকে এখন পর্যন্ত বিক্রয়ডটকম, ওএলএক্স, এখানেইডটকম ইত্যাদি কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনই বেশি দেখা যায়। তবে বাকিরাও ধীরে ধীরে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কারণ, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলে একদিন পরেই তা হারিয়ে যায়। কিন্তু ফেসবুকে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় ‘লাইক’ বা ‘ক্লিক’-এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘ক্লিক’ পেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয় এবং সেই পরিমাণ ‘ক্লিক’ না পড়া পর্যন্ত তা ফেসবুকে আবর্তিত হতে থাকে।

অন্যদিকে, ফেসবুক চলে যুক্তরাষ্ট্রের বিধিমালায়, বাংলাদেশ থেকে সে যা আয় করছে, তাতে স্থানীয় কর বিভাগের খবরদারি চলে না। এতে বৈশ্বিক ও স্থানীয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অসম ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, কারণ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানটিকে স্থানীয় নিয়ম অনুযায়ী কর প্রদান করতে হবে, স্থানীয় বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। এটা একটা আইনগত সমস্যাও বটে। স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এ রকম দানবীয় বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের কারণে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
আমরা ফেসবুক ব্যবহারকারীরা হয়তো এসবের তোয়াক্কা করি না। আমাদের ফেসবুক-সময়টি আনন্দদায়ক হলেই চলে। বিজ্ঞাপনপ্রেম কিংবা দ্বেষ সবার সমানও নয়, কিছু বিজ্ঞাপন আমার নিউজফিডে আসলে কী এমন ক্ষতি! কিছু বিজ্ঞাপন আমার টাইমলাইনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারলে অনেকেরই কোনো আপত্তি থাকবে না, কারণ আমরা ভোক্তাসংস্কৃতিতে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

তবে এই বিষয়টি জেনে নেওয়ার মধ্যে ক্ষতি নেই যে ফেসবুক প্রতিনিয়তই আমাদের বিক্রি করে দিচ্ছে এবং ফেসবুকের টিকে থাকা এবং মুনাফার নিশ্চয়তা পুরোপুরি নির্ভর করে আছে আমাদের সক্রিয় উপস্থিতির ওপর। অকুপাই আন্দোলনে কিংবা শাহবাগ আন্দোলনে ফেসবুকের অবদান যতটুকু আছে, তা ফেসবুক করপোরেশনের নয়, ফেসবুক পরিসরের।মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও উদ্যমই ফেসবুকের পরিসরটি ব্যবহার করে কোনো মহত্তর উদ্দেশে।
ফাহমিদুল হক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চলচ্চিত্র ও নিউ মিডিয়ার গবেষক।