ফারার কবলে এলামেলো-বাংলাদেশ
স্পোর্টস রিপোর্টার : চা-বিরতির পর আর ১০.২ ওভারে ৫৩৯ রানে শেষ নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংস। ৫৬ রানের লিড নিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু। টেস্টের সম্ভাব্য ফলাফল তখন ড্রই মনে হচ্ছিল। তবে দিনের শেষটা এমন এলোমেলো হয়ে যাবে, কে জানত! দিন শেষে ১২২ রানের লিডও খারাপ ছিল না। কিন্তু ততক্ষণে যে ড্রেসিংরুমে ফিরে গেছেন তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ ও মেহেদী হাসান মিরাজ! তার আগে বাঁ ঊরুর চোটে পড়ে ইমরুল কায়েস চলে গেলেন হাসপাতালেই। এক্স-রে রিপোর্টে কিছু ধরা না পড়লে তিনি আবার ব্যাট করতে নামতে পারবেন কি না, এ নিয়ে সংশয় ছিল।
শেষ বিকেলের ঝড়ের আগে বাংলাদেশের জন্য দিনটা ছিল ওয়েলিংটনের আকাশের মতোই ঝলমলে। কামরুল ইসলামের নতুন শুরু টেস্টে বাংলাদেশেরও নতুন দিনের সূচনা এনে দিল যেন। নিউজিল্যান্ড ইনিংসের ১৪০তম ওভার। কামরুলের বাউন্সার আঘাত করল নিল ওয়াগনারের হেলমেটের গ্রিলে। উইকেটে রক্ত। ওয়াগনারের ঠোঁটে তবু হাসি। পরের বলে কামরুল সেটাও মিলিয়ে দিলেন আরেকটি বাউন্সারে। আবারও হেলমেটে আঘাত। একের পর এক বাউন্সারে ওয়াগনার এতটাই কেঁপে গিয়েছিলেন যে, ওই ওভারের শেষ বলে আউটই হয়ে গেলেন।
ওয়াগনার লেজের দিকের ব্যাটসম্যান। তাঁর অবস্থা দিয়ে নিউজিল্যান্ড দলের ইনিংস মূল্যায়ন করা হয়তো ঠিক হবে না। তাহলে দিনের শুরুটা দেখুন। বা মাহমুদউল্লাহর এক ওভারে ২ উইকেট হারানোর পর তাদের ইনিংসের লেজের দিকে একটু তাকান। কত দ্রুত খসে পড়ল সেটা! কামরুলের ৩ উইকেট, অভিষেক টেস্টে শুভাশিসের ২ উইকেট, উইকেট থেকে স্পিনারদেরও সাফল্য পেতে শুরু করা—সব মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের প্রায় সাড়ে পাঁচ শ ছুঁই-ছুঁই ইনিংসের পাশেও উজ্জ্বল বাংলাদেশের বোলিং। টম ল্যাথামের ১৭৭ রান আর নিকোলস, স্যান্টনার ও ওয়াটলিংয়ের ফিফটির পরও প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ৫৯৫ কিউইদের কাছে অস্পর্শনীয় থেকে যাওয়াটাও কি কম!
কিন্তু ইমরুলের চোট শুরুতেই প্রচণ্ড ধাক্কা দিল বাংলাদেশের ইনিংসে। মুশফিকুর রহিমের অনুপস্থিতিতে দুই দিনে ১৪৮.২ ওভার উইকেটকিপিং করেছেন। বিকল্প উইকেটকিপার হিসেবে ইনিংসে পাঁচটি ক্যাচ নিয়ে করেছেন বিশ্ব রেকর্ড। এরপর আবার ওপেনিংয়ে ব্যাটিং। ইমরুল তবু শুরুটা করলেন বোল্টকে পয়েন্ট দিয়ে চার মেরে। এরপর টিম সাউদিকে দুই ওভারে চার আর ছক্কা মেরে যখন উইকেটে মোটামুটি থিতু হয়ে যাচ্ছিলেন, ভেঙে পড়লেন তখনই। রানআউটের হাত থেকে বাঁচতে ডাইভ দিলেন। আর উঠতে পারলেন না। কাতরাতে থাকলেন মাটিতে শুয়ে। ফিজিওর সাহায্যে একবার ওঠার চেষ্টা করেও পারলেন না। শেষ পর্যন্ত স্ট্রেচারে করে বের করে আনতে হয় ইমরুলকে। মাঠের পাশেই ছিল অ্যাম্বুলেন্স। সেখান থেকে হাসপাতাল।
এটি দিয়েই বিপর্যয়ের শুরু বাংলাদেশের ইনিংসে। প্রথম ইনিংসের ঠিক বিপরীত ছবি ফুটে ওঠে বেসিন রিজার্ভে। মাত্র ১৬ রানের ব্যবধানে আউট তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ ও ‘নাইটওয়াচম্যান’ মেহেদী হাসান মিরাজ। আউটগুলো বোলারদের কৃতিত্বে হলে বা উইকেটে সামান্যতম বিষ থাকলেও মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু শেষবেলায় যে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসারই প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাটসম্যানরা!
ইমরুল মাঠ ছাড়ার পরের ওভারেই স্যান্টনারের বলের লেংথ না বুঝে লেট কাট করতে গিয়ে বোল্ড তামিম। তিন ওভারের মধ্যে মাহমুদউল্লাহও একই পথে। ওয়াগনারের দেওয়া পাঁজরের কাছে উঠে আসা শর্ট ডেলিভারিতে ব্যাট লাগাতে গিয়ে কট বিহাইন্ড। এরপর বাকি ছিল শুধু কারও রানআউট হওয়া। নাইটওয়াচম্যান মেহেদী হাসান মিরাজ দূর করে দেন সে ‘অপূর্ণতা’ও। বিনা উইকেটে ৪৬ থেকে ৩ উইকেটে ৬৬! বিপর্যয়ে বাঁধ দিতে না পারলে শেষ দিনে নাটকীয় কিছু ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে আশার কথা, মুশফিকুর রহিম ব্যাটিং করতে পারবেন। সকালে নেটে অনুশীলন করেছেন, বিকেলে ড্রেসিংরুমেও প্যাড পরা অবস্থায় দেখা গেছে তাঁকে। দল থেকেও জানানো হয়েছে, আঙুলের চোট কাটিয়ে তিনি এখন ব্যাট করার জন্য প্রস্তুত।
ব্যাটসম্যানরা স্কোরবোর্ডে ভালো রান দিলে বোলারদের সাহস বাড়ে। সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক, তামিম ইকবাল, সাব্বির রহমান—প্রথম ইনিংসে পাঁচ ব্যাটসম্যান মিলে সেই সাহসটাই দিয়েছেন বোলারদের। বাংলাদেশের অনভিজ্ঞ বোলিং আক্রমণ তাতে কতটা তেতে উঠেছিল, সেটার প্রমাণ কামরুলের আগুন ঝরানো বোলিং। বল হাতে মাহমুদউল্লাহর চমকও কি নয়!
নিউজিল্যান্ড ইনিংসের ১৩৩তম ওভার। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক তামিম ইকবালের কাছ থেকে বল পেয়ে একটু অবাক হয়ে থাকতে পারেন মাহমুদউল্লাহ। নেলসনের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বল করেছেন মাত্র এক ওভার। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে এক ওভারে তিন ছক্কাসহ দিয়েছেন ২৮ রান। কাল বোলিং পেয়ে মাহমুদউল্লাহর বিস্মিত হওয়ারই কথা।
কিন্তু এবার সেই মাহমুদউল্লাহই এক ওভারে নিয়ে নিলেন ২ উইকেট। প্রথমটি অবশ্য খুবই বাজে এক বলে। সেটিতেই ওয়াটলিংকে ফিরতে হলো ইমরুলের দুর্দান্ত এক ক্যাচে। ৬ উইকেটে ৪৭১ থেকে চা-বিরতির আগেই নিউজিল্যান্ডের স্কোর ৮ উইকেটে ৪৭৩। শেষ দুই উইকেটে আর ৬৬ রান যোগ হতেই নিউজিল্যান্ডকে গুটিয়ে দিয়ে বড় হাসি নিয়ে মাঠ ছাড়েন বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডাররা।
দিন শেষে সেই হাসিটাই দেখা গেল নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়দের ঠোঁটে। ফলাফল যা-ই হোক, ওয়েলিংটন টেস্টে বাংলাদেশের একচ্ছত্র আধিপত্যটা এখন আর নেই।
চতুর্থ দিন শেষে
বাংলাদেশ: ৫৯৫/৮ ডি. ও ৬৬/৩
নিউজিল্যান্ড ১ম ইনিংস: ৫৩৯