অর্থনৈতিক রিপোর্টার : অবশেষে ফারমার্স ব্যাংকে ঝড়-ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী পদত্যাগ করেছেন। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সভায় এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এই সভায় নতুন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটি, নিরীক্ষা কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এসব বিষয় নিশ্চিত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘ফারমার্স ব্যাংকে বেশ কিছু দিন ধরে তারল্য ঘাটতি বিরাজ করছে এবং ব্যাংকটিতে আর্থিক সূচকসমূহের অবনতি ঘটে। বেশ কিছু আমানতকারী ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করার ফলে ব্যাংকটির সমস্যা ঘনীভূত হয়। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসার পর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
এর আগে রোববার রাতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীমকে কেন অপসারণ করা হবে না তা জানতে ৭ দিনের সময় বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তাদের পদত্যাগপত্র পরিচালনা পর্ষদ গ্রহণ করেছে। নতুন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মোহাম্মদ মাসুদ। একই সঙ্গে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটি, অডিট কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্গঠনের কথাও জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকটিতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া উপদেষ্টা, সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত সোমবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের তালিকা জমা দিলে তা অনুমোদন দেয়া হয়।
পুনর্গঠিত পর্ষদ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকটির ওপর ‘নজরদারি অব্যাহত’ থাকছে। বেশ কিছু আমানতকারীর ব্যাংকটি থেকে অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পদত্যাগের বিষয়ে কথা বলতে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মোবাইল ফোনে একাধিক ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর বর্তমান সংসদে সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংকটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৩ সালে অনুমোদন পেয়েছিল। তখন আটটি ব্যাংককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল, যা রাজনৈতিক বিবেচনায় বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও স্বীকার করেন। দেশের ‘চাহিদার চেয়ে বেশি’ ব্যাংককে লাইসেন্স দেয়ায় এ নিয়ে সরকারকে সমালোচনায় পড়তে হয়েছিল। যাত্রা শুরুর ৩ বছর না যেতেই ফারমার্স ব্যাংকে শত শত কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়লে সেই সমালোচনা আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
অনিয়ম ধরা পড়ার পর তখন বেসরকারি এ ব্যাংকটিতে কড়া নজরদারিতে আনতে পর্যবেক্ষক বসিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক; যদিও পরে তা আদালতে আটকে যায়। সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেয়া এক প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংককে দেশের আর্থিক খাতের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, ফারমার্স ব্যাংক সাধারণ আমানতকারী এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে অর্থ নিয়ে চলছে। দায় পরিশোধের সক্ষমতাও নেই ব্যাংকটির। এর ফলে ব্যাংকটি সমগ্র আর্থিক খাতে ‘সিস্টেমেটিক রিস্ক’ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা না মেনে ফারমার্স ব্যাংকের নতুন ঋণ দেয়ার বিষয়টিও প্রকাশ পায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়। সংসদীয় কমিটিতে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছর ধরে ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে এবং বর্তমানে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির গ্রাহক আমানত ৫ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং আন্তঃব্যাংক আমানত ৫৩৫ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়।
অন্যদিকে ব্যাংকটির কলমানি ঋণের পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ক্রয়কৃত সরকারি সিকিউরিটিজের (বিল ও বন্ড) পরিমাণ ১ হাজার ৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতাও নেই। এদিকে রোববার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফারমার্স ব্যাংকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ব্যাংকের এমডি একেএম শামীমকে কেন অপসারণ করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী তাকে এ নোটিশ দেয়া হয়েছে। চিঠিতে আগামী ৭ দিনের মধ্যে এমডিকে কেন অপসারণ করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, ব্যাংকে তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে এমডি ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে নগদ জমা বা সিআরআরের এবং সংবিধিবদ্ধ জমা বা এসএলআরের অর্থ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নতুন করে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। নোটিশে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে।