ফাঁসির রশিতে ঝুলল জাসদ নেতা কাজী আরেফসহ ৫ নেতার খুনিরা
বিশেষ প্রতিবেদক: দীর্ঘ ১৭ বছর পর ব্রাশফায়ারে নিহত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কাজী আরেফ আহমেদসহ দলের পাঁচ নেতার খুনিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তিন খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ।
এই তিনজন হলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার রাজনগর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে সাফায়েত হোসেন হাবিব, কুর্শা গ্রামের উম্মত মণ্ডলের ছেলে আনোয়ার হোসেন ও সিরাজ ওরফে আবুল হোসেনের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু ওরফে আকবর।
রাত ১১.০৩ মিনিটে হাবিবুর ও আনোয়ারের একসঙ্গে ও রাত ১১.১৫ মিনিটে ঝন্টুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাদের লাশ রাতেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। দেরিতে হলেও দোষীদের সাজা কার্যকর হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন কাজী আরেফের সহধর্মিণী রওশন জাহান সাথী। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আরও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন জাসদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও যশোর জেলা শাখার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে এ তিনজনের ফাঁসি কার্যকরের জন্য বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। ফাঁসির আসামি ঝন্টু, হাবিব ও আনোয়ারের পরিবারের সদস্যদের শেষ সাক্ষাৎ করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। গতকাল বিকেলে একটি অ্যাম্বুলেন্সে ঝন্টু ও আনোয়ারের পরিবার এবং সন্ধ্যায় হাবিবের পরিবার শেষ সাক্ষাতের জন্য কারাগারে আসে।
রাত সাড়ে ১০টায় তারা তিনজনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন। কারাগারে দেখা করেন আনোয়ারের ভাই আবদুল হান্নান ও ছেলে ডালিম। তারা বলেন, সাক্ষাৎকারে ডালিম নির্বিকার ছিলেন। সাক্ষাৎ শেষে হাবিবুর রহমানের ছেলে মিঠুন মণ্ডল ও ভাই হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তারা দরিদ্র মানুষ। টাকার অভাবে আইনজীবী দিতে না পারায় তারা সুবিচার পাননি। ঝন্টুর সঙ্গে দেখা করে এসে সাংবাদিকদের কিছু বলেননি ভাগ্নে সোহেল ও মানিক।
কারাগারের নিরাপত্তার জন্য সন্ধ্যার পর থেকেই গোটা এলাকায় পুলিশ ও র্যাবের পাহারা বাড়ানো হয়। রাতে একে একে কারাগারে প্রবেশ করেন যশোরের জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ুন কবীর, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, সিভিল সার্জন শাহাদাত হোসেন ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল হাসান।
রাতে তিন আসামিকে গোসল করানোর পর তাদের তওবা পড়ান কারা মসজিদের ইমাম রমজান আলী। রাতে স্বজনদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের পর তাদের খাবার খাওয়ানো হয়। এরপর তাদের রায় পড়ে শোনানো হয়। নিম্ন আদালতের রায়, আপিল এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমার আবেদন নামঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি তাদের জানানো হয়।
এরপর তাদের জমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। তাদের ফাঁসি কার্যকর করেন জল্লাদ তানভীর হাসান রাজু ও হযরত আলী। ফাঁসি কার্যকর করার জন্য দু’দিন আগেই তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে যশোরে নিয়ে আসা হয়। এ সময় জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছাড়াও ডিআইজি (প্রিজন) টিপু সুলতান ফাঁসি মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।ফাঁসি কার্যকরের পর সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে চিকিৎসক তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর ফরেনসিক টিম তাদের পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করে।
এদিকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কাজী আরেফের সহধর্মিণী রওশন জাহান সাথী বলেন, আমরা আইনের শাসন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সেখান থেকে যে রায় এসেছে এবং কার্যকর হয়েছে_ তা অবশ্যই ইতিবাচক। এর মধ্য দিয়ে আইনের শাসন এগিয়ে যাবে এবং দেশের মানুষ আইনের শাসনের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হবে বলে আমি আশা করি। এ ধরনের অপরাধ যারা করে, সেসব অপরাধীর শাস্তি হবে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না, পার পাওয়া উচিতও নয়।
মহিলা শ্রমিক লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রওশন জাহান সাথী আরও বলেন, কাজী আরেফ আহমেদের মতো এত বড় মাপের একজন নেতা, যিনি মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন এবং দেশ, জাতি ও সমাজের কল্যাণে সংগ্রাম করে গেছেন তাকে এভাবে হত্যা করাটা অন্যায়। এ ধরনের অন্যায় করে দেশ, জাতি ও সমাজ এগুতে পারে না, বরং পেছনের দিকে যায়। তাই এমন অন্যায় হত্যাকাণ্ড আর হবে না সেটিও আমি প্রত্যাশা করি।
পুলিশ ও কারাগার সূত্রের মতে, ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় দুর্বৃত্তদের ব্রাশফায়ারে খুন হন জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ, কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরাইল হোসেন ও শমসের মণ্ডল। ওই ঘটনার পরদিন দৌলতপুর থানার তৎকালীন এসআই মো. ইসহাক আলী বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলা জজ আদালত এ হত্যা মামলায় ১০ জনের ফাঁসি এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। পরে আসামিরা হাইকোর্টে আবেদন করেন। ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট আদালত ফাঁসির এক আসামি ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১০ জনকে খালাস দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ (বাদী) সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন।
২০১১ সালের ৭ আগস্ট হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। পরে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ করেন। ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর এ আবেদন খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। পরে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন সাফায়েত হোসেন হাবিব, আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু। এ আবেদন নাকচ করে দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
৯ জনের মধ্যে এই তিনজনের মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে কার্যকর করা হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা যান মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি ইলিয়ার হোসেন ওরফে এলাচ। এ মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য পাঁচ আসামি এখনও পলাতক। তারা হলেন_চরমপন্থি দলের সক্রিয় সদস্য কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পচাভিটা গ্রামের মান্নান মোল্লা, মিরপুর উপজেলার কুর্শা মেহেরনগরের রমজান আলীর ছেলে জাহান আলী, বালিয়াশিষা গ্রামের হারেজ উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দিন, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের নায়েব মণ্ডলের ছেলে রওশন ও কিশোরীনগর গ্রামের মোজাহার উদ্দিনের ছেলে বাকের উদ্দিন।