ফখরুলের বয়ান-ব্যাংক লুটপাটে সরকারের সরাসরি হাত রয়েছে
বিএনপি নেতা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবার বয়ান দিয়েছেন-ব্যাংকে লুটপাটে সরকারের সরাসরি হাত ও পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে । রোববার বিএনপির গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ অভিযোগ করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের হিসাব অনুযায়ী মার্চ ২০১৭ শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার ৪ শত ৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট ঋণের ১০.৫৩%। ২০১৬ মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪ শত ১১ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এসব মন্দ ঋণ আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এ তথ্য খেলাপির হিসাবে নিলে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা।
হিসাবটি আঁতকে ওঠার মতো। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টিম সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপ অবৈধভাবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার জালিয়াতি শনাক্ত করে। এরপর একে একে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি এবং বেসিক ব্যাংকসহ দেশের অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি ও জনগণের অর্থ লোপাটের লোমহর্ষক খবর দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে।
তিনি বলেন, লুটেরারা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগার বাংলাদেশ ব্যাংকেও হাত দিয়েছে। তারা ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৮০৮ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। সরকার এই বিষয়ে অনুষ্ঠিত তদন্ত প্রতিবেদনটিও ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। কার স্বার্থে বা কাকে আড়াল করার জন্য এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হচ্ছে না তা জাতি জানতে চায়।
তিনি বলেন, দেশে কোথাও সুশাসন নেই; সুশাসন থাকলে সর্বক্ষেত্রে এই অরাজকতা চলতো না। ব্যাংকে লুটপাট সরকারের পাশের লোক না হলে কেউ করতে পারে না। এতে সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে বলে স্পষ্ট। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ জালিয়াতি এবং অর্থ লোপাট সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন-নিবন্ধে প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। বলা বাহুল্য, এই অর্থ লোপাট ও অর্থ পাচারের কোনো ঘটনার বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা আজো নেয়া হয়নি, যা রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার।
ফখরুল বলেন, একটি সূত্র মতে, লুটপাটের মহোৎসবে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। জনগণের করের টাকায় মেটানোর চেষ্টা চলছে এই মূলধন ঘাটতি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ২০১১-১২ থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এমন কী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও ২ হাজার কোটি টাকা মূলধন বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। বাজেট বক্তৃতায় বুদ্ধিমান অর্থমন্ত্রী অবশ্য বিষয়টি চেপে গেছেন। সাধারণ মানুষের রক্ত পানি করা টাকা শুষে নিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে ব্যাংকগুলো।
কিন্তু খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অর্থমন্ত্রী তাদের চোখে দেখেন না। তার চোখ আটকে যায় মধ্যবিত্তের তিলতিল করে জমানো ১ লক্ষ টাকার ওপর। সরকারি ব্যাংকগুলো দলীয় লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়ার পর সরকার এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের জন্য আইন সংশোধন করে এক পরিবার থেকে দুই জনের স্থলে চার জন পরিচালক এবং পরপর দুই মেয়াদের পরিবর্তে তিন মেয়াদ অর্থাৎ টানা নয় বছর পরিচালক থাকা বৈধ ঘোষণা করেছে। এটি কেবল অনৈতিকই নয়, সাধারণ জনগণের পকেট মেরে দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের প্রশ্রয় ও উৎসাহ দেবার শামিল।
যেখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংস্কার করে আর যেন এই ধরনের লুটপাট না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, সেখানে সরকার সংস্কারের দিকে না গিয়ে আরও সহজে লুটপাটের ব্যবস্থা করছে। নির্বিচারে ব্যাংকের অর্থ লোপাট এবং বিদেশে ঢালাও অর্থ পাচারের পরিণতিতে দেশের অর্থনীতির আজ যেই দৈন্যদশা, তা সামাল দেয়ার নিমিত্তে অর্থমন্ত্রী জনগণ থেকে সম্ভাব্য যেকোনো উপায়ে রাজস্ব আদায়ের সংস্থান রেখে এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান লাভের স্বপ্নজাল বুনে এক উচ্চমাত্রার বিলাসী বাজেট প্রণয়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না। আর বধির হলেই বজ্রনাদ থেমে থাকে না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেট ব্যয়ের লক্ষ্য ছিল ৩ লক্ষ ৪০ হাজার ৬ শত ৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই ব্যয়ের মাত্রা নিম্নমুখী সংশোধন করে স্থির করা হয়েছে ৩ লক্ষ ১৭ হাজার ১ শত ৭৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত প্রকৃত ব্যয়ের পরিমান ১ লক্ষ ৪৯ হাজার ৩ শত ৩৩ কোটি টাকা। এনবি আর-ট্যাক্স রাজস্ব এর লক্ষ্য ছিল ২ লক্ষ ২ হাজার ১ শত ৫২ কোটি টাকা। পরে এই অংককে সংশোধন করে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কাক্সিক্ষত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
ঐ বাজেটে বহিঃসম্পদ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ হাজার ৩ শত ৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ২৮ হাজার ৭ শত ৭১ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এই সূত্র থেকে এসেছে মাত্র ২ হাজার ৫ শত ৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ এবং বৈদেশিক সূত্র থেকে সম্পদ আহরণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম হয়েছে। তাই আমরা সন্দিহান, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য বাজেটের যে আকার প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি অর্থায়নের জন্য দেশি এবং বিদেশি সূত্র থেকে কাক্সিক্ষত মাত্রায় সম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের অনুন্নয়ন খাত ও উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সংশোধিত বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় জিডিপির ৯.১% এবং উন্নয়ন ব্যয় জিডিপির ৫.৯%। অর্থাৎ জিডিপির অংশ হিসেবে উন্নয়ন ব্যয় অনুন্নয়ন ব্যয়ের তুলনায় ৩.২% কম। অথচ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অনুন্নয়ন ব্যয় উন্নয়ন ব্যয়ের তুলনায় কম থাকাই কাক্সিক্ষত।
বাজেটের উন্নয়ন ব্যয়ের হিস্যা বাড়ানো সম্ভব হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অধিকতর ত্বরান্বিত করা সম্ভব। একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সনের মে মাস পর্যন্ত ১১ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৬৫% বাস্তবায়িত হয়েছে। অর্থবছরের শেষ ১ মাসে উন্নয়ন বাজেটের অবশিষ্ট অর্থ ব্যয় দেখাতে হলে সেই ব্যয় দুর্নীতি আর অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের সম্পদ সীমিত। সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার দেশের প্রতিটি করদাতা নাগরিকের কাম্য।
তিনি বলেন অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ডকুমেন্ট এর শিরোনামের সঙ্গে দুটি শ্লোগান ব্যবহার করেছেন। শ্লোগান দুটি হ’ল ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশঃ সময় এখন আমাদের’। কিন্তু এই ‘উন্নয়নের মহাসড়ক’ খানাখন্দকে ভরা। এর উপর দিয়ে চলতে গেলে পদে পদে দুর্ঘটনার আশংকা। বাজেটের আকার বড় করা হলেই ভাল বাজেট হয় না। অতীতের বাজেটগুলোর ভাগ্যে যা ঘটেছে অর্থাৎ আয়ের লক্ষ্য পুরণ না হওয়া এবং একই সাথে ব্যয়ের লক্ষ্য পুরণ না হওয়া, তা প্রস্তাবিত বাজেটের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে বলে আশংকা।
বিশাল এই বাজেটটি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই বাজেটের কিছু কিছু প্রস্তাব আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। লোকের চোখে দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে গিয়ে, দ্বিগুন চারগুন অর্থ ব্যয় করে একদিকে সম্পদের অপচয় ঘটানো হচ্ছে, অন্যদিকে রেন্ট-সিকিং বা দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে না। প্রকল্প ব্যয়েও স্বচ্ছতা নেই। ব্যয়ের গুনগত মান বজায় রাখা হচ্ছে না।
যে বাজেটে ব্যয়ের গুনগত মান বাড়ানোর কোন দিক নির্দেশনা নেই সেই বাজেট জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ৪ লক্ষ ২ শত ৬৬ কোটি টাকার বাজেটে ১ লক্ষ ১২ হাজার ২ শত ৭৫ কোটি টাকার ঘাটতি দেখিয়ে যে বিরাট আকারের বাজেট, এই বাজেটের অর্থ কি? এটা নিছক বিরাট-অংকের-বাজেট প্রচারণার ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বাজেট মানুষকে বোকা বানানোর বাজেট, এ বাজেট প্রতারণার বাজেট। একজন অর্থনীতিবিদের মতে, ঘাটতি বাজেটের অর্থ পাওয়া যাবে কি না তা গুরুত্বপুর্ন নয়, কেননা মূল বাজেটই তো হবে না।
ফখরুল আরও বলেন, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সময় এখন আমাদের’। এই সময় যদি তাঁর দলের জন্য সময় হয় তাহলে এর মধ্যে এক ধরনের সত্যতা আছে। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় বসে তথাকথিত‘বিজয়ী’ হয়ে তারা এখন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। বাজেটে উপেক্ষিত থেকেছে মানব উন্নয়ন খাত, এমনকি কৃষিও। প্রাধান্য পেয়েছে চোখ ধাঁধানো কিছু মেগা প্রকল্প। যেভাবে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে, ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এগুলোর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে; তার ফলে এসব প্রকল্পের উপযোগিতা কতদিনে উঠে আসবে এবং আদৌ উঠে আসবে কি না তাও অনিশ্চিত।
এই বাজেট বেপরোয়া অর্থ সংগ্রহের বাজেট। রাজস্ব আদায় ছাড়াও বাজেটের বেশ কিছু কল্যাণ মুখী লক্ষ্য থাকে। এই বাজেট দেখে মনে হচ্ছে কল্যাণমুখি লক্ষ্যগুলো অর্থমন্ত্রীর বিবেচনায় আসেনি। এসব কারনে আমরা আশাহত এবং ক্ষুব্ধ। জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন পার্লামেন্টে যেখানে কোন জবাবদিহিতা নেই, সেই পার্লামেন্টে এই বাজেট পেশ করা হয়েছে। এখানে সরকারের দায় কথায়? জনগণের কাছে সরকারের কোন দায়বদ্ধতা নেই বলেই এই বঞ্চনার বাজেট জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।