প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ-সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা
বছর ঘুরে আবার এল পয়লা বৈশাখ। যা কিছু জীর্ণ-পুরোনো, অশুভ ও অসুন্দর, তা পিছে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে বাঙালি বরণ করে এই দিন। শুরু হলো আরও একটি নতুন বছর: ১৪২১ বঙ্গাব্দ। আমরা সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
বাঙালির নববর্ষ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যময় উৎসব। কেননা, পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন, পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। দিনে দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায়নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। এমন অসাম্প্রদায়িক উৎসব সত্যিই পৃথিবীতে বিরল।
বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী যখন তাদের অন্যায়-অন্যায্য শাসনকে ন্যায্যতা দিতে ধর্ম ব্যবহার করতে চেয়েছে, তখন এ ভূখণ্ডের বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করেছে তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়। ষাটের দশকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির আত্মপরিচয়ের আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করেছিল। সেই একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রেরণা জুগিয়েছিল ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামেও।
পয়লা বৈশাখের উৎসব শুরুর দিকে ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক: গ্রামীণ মেলা, লোকজ নানা ধরনের খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল এর প্রধান আকর্ষণ। দিনে দিনে এই উৎসব শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে এবং এখন পয়লা বৈশাখের উৎসবের আড়ম্বর শহরগুলোতেই বেশি লক্ষ করা যায়। ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে সূচিত বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়াও মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়, মেলা বসে। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, ব্যবসায়ীরা খুলে বসেন হালখাতা। তরুণ-তরুণীরা বৈশাখী উৎসবের রঙিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসে, ঐতিহ্যবাহী দেশি খাবারের উৎসব চলে। সর্বত্র দেখা যায় নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস।
বাংলা নববর্ষকে ঘিরে দেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যরুচির মর্যাদা বেড়েছে; সাম্প্রতিক সময়ে এসব পণ্য বিপণনে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা। সর্বস্তরের মানুষের মিলন ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয় পয়লা বৈশাখের এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবেই। অবশ্যই একটি বেদনাদায়ক স্মৃতিও আমাদের তাড়িত করে: ২০০১ সালের পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে জঙ্গিদের হামলায় নয়জন মানুষ প্রাণ হারান। হত্যাকারীদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও সেই হত্যার বিচার আজও হয়নি। আজকের দিনে আমরা প্রত্যাশা করি, সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে বিচার দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
পয়লা বৈশাখে আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে সুর মিলিয়ে বলি: বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। নববর্ষ মানেই নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সংকল্প।