পীর-খানকা-‘শিরক’ মনে করে-জেএমবি-প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা খিজির হত্যায় জড়িত
বিশেষ প্রতিবেদক.ঢাকা: পীর-খানকা-‘শিরক’ মনে করে-জেএমবি আর এজন্যই প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা খিজির খানকে হত্যা করেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে হত্যায় জেএমবির জঙ্গিরা জড়িত ছির। টাঙ্গাইল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া তরিকুল ইসলাম এ ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তরিকুল জানিয়েছেন, ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে তাঁরা খিজির খানকে হত্যা করেছেন। তাঁরা পীর-খানকা-মানত—এসবকে ‘শিরক’ মনে করেন।
গত বুধবার টাঙ্গাইল থেকে তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক ওরফে মিঠুকে ও ঢাকার মিরপুর থেকে গাড়িচালক আলেক ব্যাপারীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাঁদের কাছ থেকে খিজির খানের বাড়ি থেকে লুট হওয়া দুটি ল্যাপটপ, দুটি ক্যামেরা ও স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়।এ দুজনকে গতকাল বিকেলে আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। ঢাকা মহানগর হাকিম রাশেদ তালুকদার দুজনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মনিরুল ইসলাম বলেন, তরিকুল নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) অন্যতম সংগঠক। তিনি ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে বোমা হামলার পর চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচ বছর কারাভোগ করেন। এরপর মুক্তি পেয়ে তরিকুল জেএমবিকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। দুই বছর ধরে তাঁরা মাজার মতাদর্শ ও পীরদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। এর অংশ হিসেবেই ৫ অক্টোবর তাঁরা খিজির খানকে খুন করেন।
মনিরুল ইসলাম বলেন, খিজির খানকে হত্যায় মোট আটজন অংশ নেন। এর আগে রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় খিজির খানের বাড়িতে ‘রহমতিয়া খানকা শরিফে’ কারা আসা-যাওয়া করে, সেটা পর্যবেক্ষণ করে জঙ্গিরা। এরপর ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় তরিকুলের নেতৃত্বে চারজন গাড়িতে করে এবং অপর চারজন নিজেদের মতো করে খিজির খানের বাড়িতে আসেন। তাঁদের মধ্যে তরিকুলের নেতৃত্বে চারজন দোতলার খানকা শরিফে গিয়ে খিজির খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং কথা বলতে থাকেন।
এ সময় অপর চারজন তৃতীয় তলায় বাসায় ঢুকে পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-পা বেঁধে ফেলেন। আর দোতলায় তরিকুলসহ অন্যরা খিজির খানকে জবাই করেন। এরপর তাঁরা বাসা থেকে বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আলেক ব্যাপারী গাড়িচালক, তিনি হত্যাকারীদের পূর্বপরিচিত। এ কারণে জঙ্গিরা তাঁর গাড়ি ভাড়া করে ঘটনাস্থলে যান। তবে খিজির খানকে হত্যার সময় আলেক ব্যাপারী কিছুটা দূরে ছিলেন। লুট করা মালামালসহ তাঁর গাড়িতে করেই হত্যাকারীরা পালিয়ে যান।
মনিরুল ইসলাম বলেন, হত্যায় অংশ নেওয়া কেউ কারও প্রকৃত নাম-ঠিকানা জানেন না। বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত জঙ্গিরা প্রত্যেকে ছদ্মনাম নিয়ে এ ঘটনায় অংশ নেন। তবে তাঁদের দেখলে চিনতে পারবেন বলে তরিকুল পুলিশকে বলেছেন। তরিকুল বলেছেন, হত্যার পর ঘটনাস্থল থেকে লুট করা মালামালকে তাঁরা গণিমতের মাল মনে করেন।
কিশোর বয়সেই জেএমবিতে জড়ান তরিকুল: আমাদের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, দেলদুয়ারের মৌলভীপাড়া জামে মসজিদের সাবেক ইমাম আব্দুল্লাহেল বাকীর ছোট ছেলে তরিকুল। তিনি কিশোর বয়সেই জড়িয়ে পড়েন জেএমবিতে।এলাকাবাসী জানান, জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান ২০০৩ সালের দিকে দেলদুয়ারে তৎপরতা শুরু করেন। তখন তরিকুল ছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ওই সময় তাঁদের পরিবারের অনেকেই জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হন। তখন বারপাখিয়া গ্রামে জেএমবির প্রশিক্ষণ ছিল, যা পরবর্তী সময়ে প্রকাশ পায়।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে বোমা হামলার পর তরিকুল আত্মগোপন করেন। প্রায় ছয় মাস পর চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার হন। পাঁচ বছর পর মুক্তি পেয়ে আবার স্কুলে ভর্তি হন। ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করে দেলদুয়ার লাউহাটি আরফান আলী কলেজে ভর্তি হন। ওই কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি।
বুধবার দুপুরে মৌলভীপাড়ায় তরিকুলদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বৃদ্ধ বাবা, মা ও ভাই মাসুদ মিয়াকে পাওয়া যায়। মাসুদ মিয়া বলেন, তিনি সাভারে ব্যবসা করেন। ভাইয়ের গ্রেপ্তারের খবর শুনে বাড়ি এসেছেন। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তরিকুলকে প্রতি সপ্তাহে থানায় হাজিরা দিতে হতো।
একই গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, তরিকুলদের এক চাচা ২০০৫ সালে বোমা হামলার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। এক ভগ্নিপতি এর আগে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।তরিকুলদের একাধিক প্রতিবেশী বলেন, জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তরিকুল এলাকার কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না। বুধবার আসরের নামাজ পড়ে বের হওয়ার পর গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে আটক করে তাঁদের বড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তল্লাশি শেষে তাঁকে নিয়ে চলে যায় গোয়েন্দারা।