কাজেই এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে আমার মতো মানুষদের দাওয়াত পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই পাই। কারণটা হলো আমার স্ত্রী। আমার স্ত্রীর সামাজিক যোগাযোগ ব্যাপক। অ্যাডিলেডে কোনো বাঙালির বাসাতে কিছু একটা হচ্ছে আর আমার স্ত্রী দাওয়াত পাবে না, এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। আমার স্ত্রী গাড়ি চালাতে পারে না, কাজেই আমাকেই তার চড়নদার হিসেবে যেতে হয়।
যা হোক, ভদ্রমহিলার প্রসঙ্গে আসি। তিনি একজন বিশিষ্ট গায়িকা। বয়স সত্তরের কোঠায়। তিনি তার সুরের সুধা অ্যাডিলেডবাসিদের ওপর বর্ষণ করে যাচ্ছেন এখনো, অদূর ভবিষ্যতেও করার প্রবল সম্ভাবনা।
আমি একজন অতি নগণ্য মানুষ। কাজেই বিখ্যাত লোকদের সব সময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। বিখ্যাত মানুষদের দূর থেকে দেখাই ভালো।
কিন্তু এই ভদ্রমহিলার ক্ষেত্রে সেটা হলো না। তিনি নিজেই আমার কাছে এসে কথাবার্তা আরম্ভ করলেন। বয়স্ক মানুষেরা, বিশেষ করে নারীরা নিজেদের সংসার, ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাকে এসব ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী মনে হলো না। শুধু জানা গেল যে, তার স্বামী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। আর একমাত্র ছেলে পরিবারসহ সিডনি থাকে। তার নিজের একটা গানের দল আছে। গানবাজনা ছাড়াও তিনি অনেক ধরনের সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত।
এরপর তার সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। অন্যদের মতো আমিও তাকে আপা ডাকি। সম্বোধনের ব্যাপারে এখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, কোনো ভেদাভেদ নাই। নারীরা সবাই আপা অথবা ভাবি আর পুরুষেরা ভাই, তা বয়স যাই হোক না কেন।
আমি একবার একজন নারীকে আন্টি ডেকে ফেলেছিলাম।
তিনি থমথমে গলায় বললেন, তুমি কী হিসেবে আমাকে আন্টি ডাকলে? তোমার বউ আমাকে আপা ডাকে জানো?
সরি, মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। মন থেকে বলিনি। বললাম।
মন থেকে বলনি মানে, অবশ্যই বলেছ। আমাকে অপমান করার জন্য বলেছ।
ভুল হয়ে গেছে আপা।
ওই নারী অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমার স্ত্রী অনেক কষ্টে এসে ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলল। কাজেই এসব ডাকাডাকির ব্যাপারে তখন থেকে আমি খুব সাবধান।
মূল প্রসঙ্গে আসি আবার। যে ভদ্রমহিলার কথা বলছিলাম, তার একটা পোষা পাখি আছে। অনেকবার তাকে পাখির ব্যাপারে বলতে শুনেছি। আমি পাখি পোষা পছন্দ করি না। খাঁচার মধ্যে পাখিকে বন্দী করে রাখার মধ্যে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা আছে। যারা পাখি পোষেন তারা এই নিষ্ঠুরতার ব্যাপারটাকে ধরতে পারেন না। আমি আমার অপছন্দের বিষয়টা তাকে কখনো জানাইনি। কী দরকার ঝামেলা বাড়ানোর? আমি সারা জীবন ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি, কিন্তু বাস্তবতা হলো যে, আমাকে সব সময় নানা ধরনের অযাচিত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
কিছুদিন পরে একদিন অফিস থেকে ফেরার পর দেখি আমার স্ত্রী শরবত বানিয়ে আমার জন্য বসে আছে। আমি মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। বিয়ের সতেরো বছর পরে স্ত্রীরা স্বামীদের জন্য শরবত বানিয়ে বসে থাকে না, বসে থাকে হাজারো অভিযোগ অনুযোগের ডালি নিয়ে। কাজেই ঘটনা কিছু একটা আছে। একটু জেরা করতেই আসল ঘটনা বের হয়ে আসল।
ঘটনা হলো ওই ভদ্রমহিলা দশ দিনের জন্য সিডনিতে ছেলের বাসাতে যাবেন। আগে তিনি যতবার গেছেন ততবার এক পরিচিত একজন নারীর কাছে তার পাখিকে রেখে গেছেন। কিন্তু এবারে সেই নারী মনে হয় অন্য কোথাও গেছেন। তাই তিনি আমাদের বাসাতে তার পাখিটিকে রাখতে চেয়েছেন, আর আমার স্ত্রীও রাজি হয়ে গেছে।
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এসব দেশে পোষা প্রাণী রাখার অনেক যন্ত্রণা। ঠিকমতো না রাখলে আইনি জটিলতার সম্ভাবনা। কিন্তু স্ত্রীর শুকনা মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো। সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রীর জন্য তাজমহল বানাতে পারেন, আর আমি সামান্য পাখি কয়েক দিনের জন্য রাখতে পারব না? রাজি হয়ে গেলাম।
যাওয়ার আগেরদিন সকালে এসে ভদ্রমহিলা এসে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। আমার ছেলেরা পাখিটিকে পেয়ে খুব উল্লসিত। ছোট ছেলে খাঁচার কাছে মুখ নিয়ে পাখিটাকে ডাকে আর পাখিটাও কিচিরমিচির করে। আমি বিরস মুখে বললাম, বেশি কাছে যাস না। তোদের লাফালাফি দেখে হার্টফেল করে মরে যেতে পারে। আমার স্ত্রী বিরক্ত মুখে বলল, তোমার সব সময় উল্টো পাল্টা কথা। দেখছ না পাখিটা কেমন মজা পাচ্ছে।
পরদিন এক বাঙালি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তাকে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, কোনো দিন পাখি পুষেছ? আমি মাথা নাড়লাম। তিনি আরও বিরক্ত হয়ে বললেন, তাহলে পাখি রাখলে কেন? পোষা পাখি পরিচিত পরিবেশ থেকে অন্য কোথাও গেলে অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখন ধর যদি পাখিটা মরে গেল তাহলে কি হবে বল তো?
আমি শঙ্কিত গলায় বললাম, কি হবে?
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মজা টের পাইবা টাইপের হাসি দিলেন। তার হাসি দেখে আমার চেহারা আমসি মেরে গেল। আমার শুকনা মুখ দেখে তিনি খুব আনন্দিত হলেন বলে মনে হলো। ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বললেন, এত অস্থির হইয়ো না। কোনো মতে পাখিটাকে উনি আসা পর্যন্ত বাঁচায়ে রাখো। আর ভবিষ্যতে খবরদার এই সব ঝামেলা নিবা না।
রাতে খেতে বসে খাবার আর গলা দিয়ে নামে না। আমার স্ত্রী বলল, এত টেনশন করো না। পাখিটা বেশ আছে। সারা দিন অনেক খেলা করেছে আর ডাকাডাকি করেছে। আমি চমকে উঠি। ডাকাডাকি করেছে মানে? শরীরে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমার স্ত্রী বিরক্ত মুখে বলল, পাখি ডাকাডাকি করবে নাতো কি ঝিম মেরে বসে থাকবে। ঝিম মেরে বসে থাকলেই বরং বুঝতে হবে কোনো সমস্যা হয়েছে। দেখনি মুরগির রানিক্ষেত অসুখ হলে কেমন ঝিম মেরে থাকে? পাখি ঝিম মেরে না থাকুক আমিই ঝিম মেরে গেলাম।
সকালে সব সময় ঘুম ভাঙে স্ত্রীর চেঁচামেচিতে। ছেলেদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে স্কুলের জন্য রেডি করা সহজ ব্যাপার না। আজকে ঘুম ভাঙল পাখিটার ডাকে। মনটাই ভালো হয়ে গেল। পাখির খাঁচার কাছে যেয়ে দাঁড়ালাম। ভালো করে পাখিটাকে খেয়াল করে দেখলাম। টিয়া প্রজাতির পাখি। এখানে বাজারিগার বলে। পাখিটার রং আকাশি নীল, পাখা আর মাথা সাদা কালো। আমাকে দেখে কয়েকবার লাফালাফি করে অদ্ভুত স্বরে কি যেন বলে উঠল। আমার স্ত্রীও ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে বলল, পাখিটা কি বলছে বুঝতে পারছ? আমি বললাম, আমি কি পাখির ভাষা বিশেষজ্ঞ যে বলতে পারব। আমার স্ত্রী হেসে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না? ও বলছে আই লাভ ইউ। অনেক দিন পর সকালে আমরা দুজনে এক সাথে বাগানে বসে চা খেলাম।
ভদ্রমহিলা প্রায় প্রতিদিনই পাখিটার খোঁজ নিতেন। আমি নিজেই পাখিটার খাঁচা পরিষ্কার করতাম, পানি, খাবার চেঞ্জ করে দিতাম। খাঁচা পরিষ্কার করার সময় আমার স্ত্রী পাখিটাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে রাখত। পরিষ্কার করা শেষ হলে আবার পাখিটাকে খাঁচাতে ঢুকিয়ে ফেলা হতো। যতক্ষণ খাঁচার বাহিরে থাকত পাখিটা খুব অস্থির থাকত, খাঁচার ভেতরে আবার শান্ত হয়ে যেত।
যে পাখি অনেক দিন খাঁচাতে থাকে সে খোলা আকাশে স্বাধীন ভাবে উড়তে ভুলে যায়। অনিশ্চিত স্বাধীন জীবনের চাইতে খাঁচার নিরাপদ বন্দী জীবন তার কাছে অনেক শ্রেয়। আমরা মানুষরাও কি কিছুটা এ রকম না?
কয়েকদিন পরে খেয়াল করলাম পাখিটা তেমন একটা খাবার খাচ্ছে না। কেমন যেন ঝিম মেরে থাকে। আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। আপাকে ফোন দিলাম। উনি বললেন, হয়তো পেট খারাপ হয়েছে। এ রকম মাঝে মাঝেই হয়, তখন খুব একটা খেতে চায় না। আবার বেশি বাতাসে ঠান্ডাও লাগতে পারে। রাতে একটু বদ্ধ জায়গাতে রেখো। আমি খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারলাম না। রাতে শোয়ার ঘরে খাঁচাটাকে রাখলাম। পরদিন দেখলাম অবস্থা আরও খারাপ। নড়াচড়া মোটামুটি বন্ধ। আপাকে জানালাম। উনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললেন যদি সম্ভব হয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। সেদিন ছিল বড়দিনের আগের দিন। প্রায় সবকিছুই বন্ধ। আমি ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা পশু হাসপাতাল খোলা পেলাম।
জীবনের প্রথম কোনো পশু ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম কাঠখোট্টা হবে। কিন্তু দেখলাম অতি সুদর্শন একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, সোনালি ফ্রেমের চশমা পরে আছেন। দেখলেই মনে হয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভদ্রলোক শান্ত ভাবে আমার কথা শুনলেন। অনেক সময় নিয়ে পাখিটাকে টিপে টুপে দেখলেন। বুকে স্থেথিস্কোপও লাগালেন। তার মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল।
বললেন, ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে। একটা অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে। তবে সারতে হয়তো সময় লাগবে।
আমি চিঁচিঁ করে বললাম, ইনজেকশন দেন, লাগলে কেমো দেন, কিন্তু পাখিটাকে বাঁচান।
ডাক্তার সাহেব বললেন, অনেক সময় ইনজেকশনের ধাক্কা অনেক পাখি নিতে পারে না। বিশেষ করে খাঁচাতে থাকা পাখিদের শারীরিক ক্ষমতা অনেক কম। অবশ্য এ ছাড়া আর অন্য কিছু এখন করার নাই। ইনজেকশন দেওয়া হলো। চেম্বার থেকে বের হওয়ার সময় ডাক্তার সাহেব বললেন, পাখিটা কিন্তু পুরুষ পাখি। তুমি বেশ কয়েকবার she বলেছ তাই বললাম।
পরদিন অনেক সকালে ঘুম ভেঙে গেল। রোজকার মতো পাখির খাঁচার কাছে গেলাম। দেখলাম আমার স্ত্রী খাঁচার গায়ে হাত দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে আছে। আমি কাছে যেয়ে তার কাঁধে হাত দিতেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। খাঁচার ভেতর পাখিটা দুই পা আকাশের দিকে তুলে মরে পড়ে আছে। আমি স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ।
ছেলেরা ঘুম থেকে উঠে যখন শুনল যে পাখিটা মারা গেছে, তখন তারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। কোনো পোষা প্রাণীর মৃত্যু তাদের কাছে এটাই প্রথম। মৃত্যু নামক বিষয়টার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার বয়স এখনো হয়নি তাদের।
আপাকে জানালাম। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিলেন, শুধু গলাটা একটু ভারী মনে হলো। তিনি বললেন, আমার আসতে এখনো দুই দিন লাগবে। যদি পারো বডিটাকে প্রিজার্ভ করে রেখো। পরে আবার কী মনে হলো, পরদিনই তার বাগানে কবর দিতে বললেন।
এখানে তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকেন। তাদের খবর দেওয়া হলো। দুই পরিবার মিলে পাখিটাকে নিয়ে গেলাম আপার বাসাতে। স্কাইপের মাধ্যমে তিনি আমাদের কবর দেবার জায়গা দেখিয়ে দিলেন—গোলাপ ঝাড়ের নিচে। সেখানে আমরা পাখিটিকে কবর দিলাম। কবরে নামানোর সময় স্কাইপে মনে হয় যেন শুনলাম আপা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। শক্ত খোলসের আড়ালে সামান্য একটা পাখির জন্য তার যে ভালোবাসা কত গভীর সেটা হয়তো আমরা কখনই উপলব্ধি করতে পারব না। আমরা শুধু চুপচাপ পাখিটার কবরের চারিদিকে দাঁড়িয়ে থাকলাম আর গোলাপ গাছ থেকে নিঃশব্দে গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়তে লাগল কবরের ওপরে।