পরকীয়া বান্ধবী সুমিকে নিজের মত ভোগ করতে চেয়েছিল নাগরী!
এস রহমান : পরকীয়া বান্ধবী সুমিকে নিজের মত ভোগ করতে গিয়ে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী নূরুল ইসলামকে। হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত কবি ও গীতিকার এবং সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা শাহাবুদ্দীন নাগরী এবং তার বান্ধবি সুমি।এদের সঙ্গে আরও কয়েকজন রয়েছে বলে পুলিশ জাতিরকন্ঠকে জানিয়েছেন।
পুলিশ জানায়, রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ফ্ল্যাটে ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম হত্যা মামলায় ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছেন কবি ও গীতিকার এবং সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা শাহাবুদ্দীন নাগরী। তাঁকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ওই অ্যাপার্টমেন্টের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণে করে নাগরীর জড়িত থাকার সব তথ্য প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে।
ভবনটির কেয়ারটেকার জানান, ওই ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ মেটাতে নাগরী ব্যয় করেছেন অর্ধকোটি টাকা। আর সেখানে তাঁর যাতায়াতও ছিল অবাধ। এর আগে পুলিশ নাগরীর বান্ধবি সুমেকে পাকরাও করে। গ্রেপ্তারের পর নিহতের স্ত্রী নুরানী আক্তার সুমী নাগরির সঙ্গে তার পরকীয়ার তথ্য স্বীকার করে।
ওদিকে এই হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলার বাদীও তেমনটাই দাবি করেছেন। মামলার এজাহারে আরো বলা হয়েছে, নিহতের স্ত্রী সুমী, শাহাবুদ্দীন নাগরী ও আরো কয়েকজন মিলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে সুমী পুলিশের কাছে দাবি করছেন, নূরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলেন।
এদিকে লাশ উদ্ধারের সময় সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা ও গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাবাদের উল্লেখ করে পুলিশ বলছে, হত্যার পর নূরুল ইসলামের মরদেহ প্রথমে তাঁর বেডরুমে খাটের নিচে লুকানোর চেষ্টা করা হয়। তা সম্ভব না হওয়ায় অর্ধেক অংশ খাটের নিচে ও বাকিটা মেঝের ওপর টেনে এনে ফেলে রাখা হয়।
নিহতের মুখে রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। গত বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ গিয়ে এ অবস্থায়ই পায় নূরুল ইসলামের লাশ। এ সময় ফ্ল্যাটে ছিলেন নূরুল ইসলামের স্ত্রী নুরানী আক্তার সুমী। পুলিশের সন্দেহ হওয়ায় তাঁকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব ঘটনার তথ্য।
পুলিশ জানায়, সুমীর সঙ্গে শাহাবুদ্দীন নাগরীর পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। আর এর জের ধরেই ঘটেছে এই হত্যাকাণ্ড। পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটি নূরুল ইসলামের নামে ভাড়া নেওয়া হলেও ভাড়া মেটাতেন নাগরী। সুমীর চলাচলের জন্য ১৪ লাখ টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কিনে দেন। এভাবে ওই পরিবার বিশেষত সুমীর পেছনে শাহাবুদ্দীন নাগরী এক বছরে খরচ করেছেন অর্ধকোটি টাকার মতো।
এর পর থেকেই শাহাবুদ্দীন নাগরীকে আটক করার চেষ্টা চালায় পুলিশ। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ জানতে পারে যে নিকুঞ্জের একটি বাড়িতে রয়েছেন নাগরী। গত রবিবার ভোরে সেই বাড়ি থেকেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় সুমীর গাড়িচালক সেলিম হোসেনকে। তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। নাগরী জিজ্ঞাসাবাদে সুমীর সঙ্গে পরকীয়া প্রেমের কথা স্বীকার করলেও হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিউ মার্কেট থানার ওসি আতিকুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে সব কিছু বলা যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দুপুরে শাহাবুদ্দীন নাগরীর স্ত্রী পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে থানায় যান। তিনি সেখানে কিছু সময় অবস্থান করেন।
কি ঘটেছিল সেদিন- ডম-ইনো অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটিতে গিয়ে দেখা গেছে, শাহাবুদ্দীন নাগরীকে নিয়ে আলোচনা করছে ভবনের সামনে কয়েকজন। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, নূরুল ইসলামের ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ।
ভবনের ম্যানেজার বাবু স্বর্ণকার বলেন, ১২ এপ্রিল রাত ১২টার দিকে নূরুল ইসলাম বাইরে থেকে ফ্ল্যাটে ঢোকেন। এর পর থেকে তিনি আর বের হননি। পরদিন ১৩ এপ্রিল বিকেলে শাহাবুদ্দীন নাগরী ওই ফ্ল্যাটে আসেন। বেরিয়ে যান সন্ধ্যার দিকে।
রাত ১০টার দিকে সুমীর গাড়িচালক সেলিম এসে জানান যে ম্যাডাম (সুমী) অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে ম্যাডামের বোন ফোন করে সেলিমকে জানান। সেলিম ফ্ল্যাটে গিয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে জানান, ম্যাডাম নয়, স্যার (নূরুল ইসলাম) ফ্লোরে পড়ে আছেন।
ডাক্তার ডাকা দরকার। এ সময় ওই ভবনে থাকা চিকিৎসক রবিউল হালিম মুন্নাকে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি গিয়ে পরীক্ষা করে জানান যে আরো অনেক আগেই তিনি মারা গেছেন। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। রাত ১টার দিকে পুলিশ আসে। পরে পুলিশ সুমী ম্যাডাম ও সেলিমকে আটক করে নিয়ে যায়।’
উদ্ভ্রান্ত ছিল নাগরী-
সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঘটনার দিন বিকেল ৩টা ১৩ মিনিটে ডম-ইনো অ্যাপার্টমেন্টে যান শাহাবুদ্দীন নাগরী। এরপর তিনি সন্ধ্যা ৭টা ১৭ মিনিটে বেরিয়ে যান। আসার সময় স্বাভাবিক দেখা গেলেও চলে যাওয়ার সময় তাঁকে বেশ উদ্ভ্রান্ত দেখা গেছে। ভবনের ম্যানেজার জানান, এক বছর আগে মাসিক ২৭ হাজার টাকা ভাড়ায় অ্যাপার্টমেন্টের পঞ্চম তলার বি-৪ ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন নূরুল ইসলাম।
তিনি নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দেন। তাঁরা ফ্ল্যাটটিতে ওঠার পরদিনই দুপুর ২টার দিকে শাহাবুদ্দীন নাগরী ওই ভবনে যান। কোথায় যাবেন জানতে চাওয়ায় তিনি কোন ফ্ল্যাটে কার কাছে যাবেন এসব খাতায় লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হন। তবে সেই সময় তিনি বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। ওই দিনই সন্ধ্যায় নাগরী চলে যাওয়ার সময় নূরুল ইসলামও নিচে নেমে আসেন।
তিনি ম্যানেজারসহ সিকিউরিটি গার্ডদের জানিয়ে দেন যে আগত ব্যক্তি (শাহাবুদ্দীন নাগরী) তাঁর আপন বড় দুলাভাই। তিনি এ বাসায় নিয়মিত আসবেন। তাঁর নাম-ধাম লিখে রাখার দরকার নেই। এরপর থেকে তাঁর নাম আর খাতায় এন্ট্রি করা হতো না।
ভবনটির এক গার্ড জানান, প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের দিকে নূরুল ইসলামের ফ্ল্যাটে আসতেন নাগরী। সন্ধ্যায় চলে যেতেন। ওই সময়টাতে নূরুল ইসলাম বাসায় থাকতেন না। তবে দুই-এক দিন তাঁকে বাসা থেকে বেরোতে দেখেননি তাঁরা।
বান্ধবী সুমির জন্যে নাগরী-
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে যে শাহাবুদ্দীন নাগরী নূরুল ইসলাম বা স্ত্রীর কোনো আত্মীয় নন। অথচ ওই ফ্ল্যাটে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত হন যে স্বামীর সম্মতিতেই নাগরীর সঙ্গে পরকীয়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন সুমী। আবার নাগরীর কিনে দেওয়া গাড়িতে স্ত্রীর পাশে বসে অবলীলায় যাতায়াত করতেন নূরুল ইসলাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সার্ভিস চার্জসহ প্রতি মাসে ৩৪ হাজার টাকা ফ্ল্যাটের ভাড়া দিতে হতো। বাজার খরচ থেকে ধরে গাড়ির তেল ও চালকের বেতনও দিতেন নাগরীই। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত এক বছরে শাহাবুদ্দীন নাগরী এই পরিবারের পেছনে খরচ করেছেন প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র এবং ডেকোরেশনও করে দিয়েছেন নাগরীই।
সেয়ানা নাগরী’র কান্ড-
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহাবুদ্দীন নাগরীর নিজস্ব গাড়ি থাকলেও তিনি ওই ভবনে আসতেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা রিকশায়। কোনো কোনো দিন তাঁর কিনে দেওয়া নূরুল ইসলামের গাড়িতে ভবন থেকে তাঁকে বেরোতে দেখা গেছে।
এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নাগরী কৌশলী উত্তর দিচ্ছেন। তবে ঘটনার দিন তিনি যে ওই বাসায় গিয়েছিলেন তা স্বীকার করেছেন। তবে কিভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেটা তিনি জানেন না বলে দাবি করছেন।
নাগরীর থলের বেড়াল-
সূত্রের দাবি, এ কে এম শাহাবুদ্দীন নাগরী ১৯৮৩ সালে বিসিএসের মাধ্যমে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন। চাকরির শুরু থেকেই ঘুষখোর হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেন তিনি। চাকরি জীবনে তিনি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নানাভাবে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কাস্টমসের নিলামে অংশগ্রহণ করে পাঁচ লাখ ৫২ হাজার টাকায় একটি প্রভোক্স ভ্যান ও ওয়াগনের সর্বোচ্চ দরদাতা হন চট্টগ্রামের মোহরা এলাকার মোহাম্মদ হাসান আলী। কিন্তু তাঁকে গাড়িটি হস্তান্তর না করে তত্কালীন কাস্টমস কমিশনার শাহাবুদ্দীন নাগরী বিভিন্নভাবে হয়রানি শুরু করেন এবং এক লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২ জুলাই হাসান আলী চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তে নেমে দুদক নাগরীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পায়।
এই মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে চট্টগ্রামের দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে জানান, মামলাটি এখনো বিচারাধীন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শাহাবুদ্দীন নাগরী দুই-তিন বছর আগে অবসরে গেছেন। ’ তিনি ১৯৫৫ সালের ৬ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবনগরে জন্মগ্রহণ করেন।