পদ্মা সেতু প্রকল্প ৭ আসামিকে এফআরটি ‘ ডাল মে কুচ কালা হ্যায় ’
স্টাফ রিপোর্টার.ঢাকা:
পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার এজাহারভুক্ত আসামি সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ সাত আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। রোববার এই মামলার সাত আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতার শুনানির দিন ধার্য ছিল।
ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জহুরুল হক শুনানি শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সাত আসামিকে অব্যাহতির আদেশ দেন।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।
কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে ‘ঘুষ লেনদেন ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব কাজী ফেরদাউস, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, এসএনসি-লাভালিনের সে সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল ও আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং তাঁদের স্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক মো. মোস্তফার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে দুদক।
মামলার এজাহারে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা না করা হলেও তাঁদের ‘তদন্তের আওতায়’ রাখা হয়। কিন্তু তাঁদের অব্যাহতি দেয় দুদক।দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু নির্মাণে ২৯১ কোটি ডলারের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল।
তবে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তারা অর্থায়ন স্থগিত এবং পরে তা বাতিলও করে। একপর্যায়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় বিশ্বব্যাংক ফিরলেও দুদকের তদন্তের ফলাফলে তারা অসন্তুষ্টি জানায়। এরপর সরকার দাতাদের কাছ থেকে অর্থ নেবে না বলে নিজেরাই জানিয়ে দেয়। এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার।
দুর্নীতির ‘ষড়যন্ত্রের সন্দেহে’ দায়ের করা প্রথম মামলাতেই (পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলা) ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এর আগে কখনও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সন্দেহে মামলা করেনি কমিশন। এ সংক্রান্ত প্রথম মামলাতেই চার্জশিট দিতে না পারায় খোদ কমিশনের অনেক কর্মকর্তা একে ‘দুদকের সকল অর্জন পদ্মায় বিসর্জন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ষড়যন্ত্র মামলা থেকে দুদকের এভাবে হাত গোটানো কমিশনের ‘নখ-দন্তহীনতা’ প্রকাশ বলেও মন্তব্য অনেকের।
২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় (মামলা নং-১৯) মোট ৭ জনের বিরুদ্ধে দুদকের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেইন ভূঁইয়া, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইপিসির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা, কানাডীয় প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে আসামি করা হয়।
মামলার তদন্তে একাধিকবার কানাডা সফর করে দুদকের প্রতিনিধি দল। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশ সফর করে। মামলার অগ্রগতির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল ওই সময় কমিশনকে পরামর্শও দেয়।
দীর্ঘ দেড় বছরের অধিক সময় তদন্ত শেষে কমিশন মামলাটি থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেয়। দুদকের উপ-পরিচালক মীর্জা জাহিদুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল মামলাটির তদন্ত করে।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ জহিরুল হক রবিবার সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেইন ভূঁইয়াসহ ৭ জনকে অব্যাহতি দেন।
এদিকে পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার এজাহারে সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। মামলাটির এফআরটির (ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু) মাধ্যমে তারাও এ অভিযোগ থেকে রেহাই পেলেন।
দুদক এ মামলায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্ট অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এমনকী এ মামলায় সেতু সচিব মোশাররফ হোসেইনকে কারাভোগও করতে হয়েছে।
মামলা দায়েরের সময় দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছিলেন, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।’
মামলার প্রধান আসামি মোশাররফ হোসেইন দুদকের রিমান্ডে এসে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এ মামলা কোর্টে উঠলে আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব।’অবশেষে তাকে আর তুড়ি মারতে হলো না। কমিশন নিজেই ভুল স্বীকার করে মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়।
দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘প্রাথমিক সত্যতা আর চূড়ান্ত সত্যতা এক নয়। প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তি ছিল পত্রিকার তথ্য ও বিশ্বব্যাংকের আশ্বাস। ২০১১ সালে পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা দুর্নীতির তথ্য জানতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘২০১২ সালের কোনো এক সময়ে অনুসন্ধান করে আমরা কোনোকিছু না পেয়ে অভিযোগটি নথিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেই। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে আমরা একটি টিম গঠন করি। দুদক টিম দীর্ঘদিন এ অভিযোগ অনুসন্ধান করে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি টিম একাধিকবার দুদকে আসে এবং কয়েক দফায় আমদের সঙ্গে বৈঠক করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমারা একটি মামলা রুজু করি। মামলাটি দুর্নীতির জন্য নয়, মূলত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলা। তদন্তে আরও তথ্য পাওয়ার আশায় আমরা মামলা দায়ের করি। তদন্তকালে দেশে ও বিদেশে গিয়ে দুদকের তদন্ত দল অভিযান চালায়। দুদক টিম কানাডা গিয়ে কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করে। বিশ্বব্যাংকের আশ্বাসের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হলেও তদন্তে দাতা সংস্থা ও কানাডা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত মামলা থেকে সকল আসামিকে অব্যাহতির (এফআরটি) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘আমাদের তদন্তে ঘটনাক্রমে প্রমাণ হয়েছে যে, পরামর্শক নিয়োগে কোনো ষড়যন্ত্র হয়নি। শুধুমাত্র বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ‘ডায়েরি’ শব্দটা ছিল। কানাডার আদালতে তা বলা হয়েছে ‘নোটবুক’। আমরা ওই নোটবুকের কপি পর্যালোচনা করে দেখেছি। তাতে কোনো আসামিকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।’
মামলায় আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়ে চুপ্পু বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তারা আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ দেবেন। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার আশায় আমরা এজাহার করি। তদন্তের স্বার্থে এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতারও করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কানাডার কোর্টের মামলার ধরন এবং বাংলাদেশের মামলার ধরন এক নয়। কানাডায় যে মামলা চলছে, তা ষড়যন্ত্রের মামলা নয়। তবে আমাদের দেশে যে মামলা হয়েছিল, তা ষড়যন্ত্রের মামলা। ফলে কানাডার আদালতের রায়ে আমাদের এ মামলায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।’