নয়া সাইবার নিরাপত্তা আইন-হ্যাকিংয়ে জরিমানা ১ কোটি-মানহানিতে ২৫ লাখ
বিশেষ প্রতিনিধি : আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানির মামলায় কারাদণ্ড দেয়া ও গ্রেপ্তার করার বিধান বাতিল করে প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন। এই আইনে মানহানির জন্য সাজা হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে অর্থদণ্ড। আর হ্যাকারদের দৌরাত্ম বেড়ে যাওয়ায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে নতুনভাবে যুক্ত করা হয়েছে হ্যাকিংয়ের জন্য সাজা। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিতে পারবেন আদালত।একইসঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বহুল আলোচিত কয়েকটি অজামিনযোগ্য ধারা বাতিল করে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। তবে নতুন সাইবার আইনেও কয়েকটি ধারা অজামিনযোগ্যই থেকে যাচ্ছে।
সোমবার সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’-এর প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়।আনিসুল হক বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধেই নতুন আইন করা হয়েছে। আর সাইবার নিরাপত্তা আইন নতুন আইন হিসেবে এলেও আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়নি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে সব মামলা হয়েছে সেগুলো চলমান থাকবে বলেও জানান তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, আগের আইনে যে সব মামলা হয়েছে তা চলবে। তবে এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনের আদলে হবে।জাতীয় সংসদের আগামী সেপ্টেম্বরের অধিবেশনে সাইবার নিরাপত্তা আইন পেশ করা হবে এবং সংসদে নতুন এই আইনটি পাশও হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আইনে কী কী পরিবর্তন আসছে তা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন আনিসুল হক। তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক সাইবার নিরাপত্তা আইন উপস্থাপন করার পর এটির নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। আইনমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সাইবার সিকিউরিটি আইন আরো কড়া। আর পাঁচ বছর আগে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ভুল ছিল না। তবে আমরা জনগণের কথা শুনি। তাই অপব্যবহার রোধে আইনটি সংশোধন করা হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে যা আছে- আইনমন্ত্রী বলেন, সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে সব ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল তা নতুন আইনেও বহাল থাকবে। তবে অনেক ধারা অজামিনযোগ্য ছিল। সেগুলোতে জামিন দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
সাইবার সিকিউরিটি আইনের ২৯ ধারায়, মানহানির জন্য সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে । তবে দণ্ডিত হয়ে কেউ জরিমানার অর্থ পরিশোধ না করতে পারলে তখন ৩ থেকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া যাবে। আগের আইনের এই ধারায় সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। আইনমন্ত্রী জানান, মানহানির মামলায় এখন গ্রেফতার করা যাবে না। ২৯ ধারা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। শাস্তি হবে শুধু জরিমানা। জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হলেই কেবল কারাদণ্ড দেয়া যাবে।
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হ্যাকারদের দৌরাত্ম বেড়ে যাওয়ায় সাইবার নিরাপত্তার আইনে হ্যাকিংয়ের অপরাধে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে অর্থদণ্ডও। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মোট ধারা রয়েছে ৫৩টি। এগুলোর মধ্যে ১৪টি ধারা অজামিনযোগ্য। এগুলো হচ্ছে- ধারা ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কার্যকর করার পর থেকেই সব থেকে আলোচনায় ছিল এই অজামিনযোগ্য ধারা। বেশিরভাগ মামলাও হয়েছে এই ধারাতেই।এরমধ্যে ধর্মীয় উস্কানি ও অনুভূতির আঘাতে ২৮ নম্বর ধারার যে অজামিনযোগ্য বিধান ছিল তাও বদলে ফেলা হয়েছে।
নতুন আইনে বেশ কয়েকটি ধারা জামিনযোগ্য করা হলেও আগের আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ নম্বর ধারা অজামিনযোগ্যই থাকছে বলে জানান আইনমন্ত্রী। আগের আইনের ৩০ নম্বর ধারা অপরিবর্তিত রাখা হলেও ৩১ ধারায় সাজার মেয়াদ সাত বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। আর ৩২ ধারা পাল্টে সাজার মেয়াদ কমিয়ে ১৪ বছর থেকে সাত বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে।
হ্যাকিং সম্পর্কিত ধারা ও সাজা
ডিএসএ’র ৩১ ধারায় এর আগে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৭ বছর এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। একাধিক বার একই অপরাধ করলে সাজা বেড়ে ১০ বছর এবং জরিমানা ১০ লাখ টাকা করার বিধান ছিল।
এই ধারায় পরির্বতন এনে সাজার সময়-সীমা কমানো হয়েছে। আগে সাত বছরের কারাদণ্ডের পরিবর্তে এটা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। বার বার একই অপরাধ করলে সাজা বাড়ানোর বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে।৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের শাস্তি আগে ছিল ১৪ বছর, সেটি কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। বারবার এই অপরাধ করলে সাজা বাড়ার বিধান বাতিল করা হয়েছে। ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
হ্যাকিং হচ্ছে, কম্পিউটার তথ্য ভাণ্ডারের কোন তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তন বা তার মূল্য বা উপযোগিতা কমানো বা অন্য কোন ভাবে ক্ষতিসাধন বা নিজ মালিকানা বা দখল বিহীন কোন কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে তার ক্ষতিসাধন হবে হ্যাকিং।ডিএসএ এর ৩৩ ধারায় বলা হয়েছিল যে, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার বা ডিজিটাল সিস্টেমে বে-আইনিভাবে প্রবেশ করে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো আর্থিক বা বাণিজ্যিক সংস্থার কোনো তথ্য-উপাত্তের কোনো ধরণের সংযোজন বা বিয়োজন, স্থানান্তর বা স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তা অপরাধ বলে ধরা হবে।