নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে খালেদা নিশ্চুপ-
বিশেষ প্রতিনিধি : এবার বিএনপির টার্গেট নির্বাচনকালীন সরকার। এরজন্য নিজেরা তৈরী করছেন রুপরেখা। সরকার মানুক আর নাই মানুক তাঁরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বলছেন শিগগির এই রুপরেখা প্রকাশ করা হবে।
নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি ক্ষমতাসীনরা মানবেন, এমন আভাস-ইঙ্গিত’ও নেই। তারপরও তারা রহস্যময় গো ধরে আছেন। তবে নেতারা যাই বলুক দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলছেন না।
ওদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান রেখে বিএনপিসহ অন্যান্য দল থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য করে নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। তারা মনে করেন, এতে সরকার বিএনপির প্রস্তাবের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে পারে।
অনেকে বলছেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, আলোচনার টেবিলেই তা নির্ধারণ হবে। দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী ফর্মুলাই দেবে বিএনপি।
২০১৯ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বললেও এখনও কোনো ধারণা দেয়নি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন সরকার ঠিক করবেন। এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। তিনি যাকে যাকে ওই সরকারে নেবেন বলে মনে করেন, তাদের নিয়েই নির্বাচন পরিচালিত হবে।
তবে বিএনপির একাধিক নেতা বলছেন, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে। কাজেই সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে নামেই হোক নির্বাচনকালে একটি নিরপেক্ষ সরকার লাগবেই। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ই এখন বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে তারা এও বলেন, এবার আর একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।
২০১৯ সালের নির্বাচনের জন্যে একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের রূপরেখার খসড়া তৈরির কাজ শুরু করেছে বিএনপি। বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব ও ক্ষমতা কী, তা সংগ্রহ করছেন। একই সঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছেও রূপরেখার জন্য ফর্মুলা সংগ্রহ করা হচ্ছে। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করা হবে।
নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে রূপরেখা উপস্থাপন করবেন। দলের কেউ কেউ প্রস্তাব করছেন, সংবিধান সংশোধন না করে ওই সময় সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে বিএনপিসহ অন্য দলগুলো থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়ে ১০ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করা যেতে পারে।
সূত্রমতে, সারাদেশে নির্বাচনী আবহ তৈরি হলে প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব হ্রাস পাবে। প্রশাসনও নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ওই নেতাদের যুক্তি হচ্ছে, সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে রাখলে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে পারে। এই ফর্মুলায় একটি জাতীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে- এমন প্রস্তাব দেওয়ার ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা করছেন অনেকে।
তবে দলের বড় একটি অংশ চায়, বিএনপির রূপরেখায় সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে না রাখতে। তাদের মতে, সরকার প্রধানের ব্যাপারটি অস্পষ্ট রাখা উচিত হবে। সমঝোতার টেবিলে বসলে সব দলের মতামতের ভিত্তিতে সরকার প্রধানের নাম চূড়ান্ত করা যাবে।
সূত্রমতে, রূপরেখার প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে থাকবে নির্বাচনকালে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা। ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়োগ দেওয়া। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ পুরো প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়েরকৃত মামলাগুলো প্রত্যাহার ইত্যাদি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হতে হবে। ওই নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারে না। বিগত বছরগুলোতে প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনই তার প্রমাণ। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে- এমন একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার প্রয়োজন। বিএনপি সে ধরনের অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের জন্য শিগগিরই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়েই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছেন।
নির্দলীয় সরকারের যৌক্তিতার জন্য এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে। বর্তমানে পরিবেশের আরও অবনতি ঘটেছে। স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে দেখা দিয়েছে- ওই সরকার যে নামেই হোক।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অতীতের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হলেও নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দলীয় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কাজ করে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাধীনভাবে কর্মসূচি পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
বিএনপির আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি গণতন্ত্র, সংবিধান এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করছে। সে জন্য নির্বাচন কমিশন গঠনে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরির জন্য ১৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা অচিরেই প্রস্তাব আকারে প্রকাশ করা হবে।
ওদিকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলছেন অন্য কথা। তারা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। একাদশ সংসদ নির্বাচনের এখনও অনেক বাকি। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।