• বৃহস্পতিবার , ২১ নভেম্বর ২০২৪

নাসা দরবেশের পোদ্দারি


প্রকাশিত: ৯:১৭ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২৪ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪৯ বার


০০ প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে টাকা দিতে বাধ্য করতেন-
০০ জোর করে শেখ হাসিনা ফুটবল টুর্নামেন্টে টাকা নিয়েছেন-

 

প্রিয়া রহমান : ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে কথিত নাসা দরবেশ নজরুল ইসলাম মজুমদারের মাত্রাতিরিক্ত পোদ্দারিতে (পরের ধন সম্পদের ওপর খবরদারি) অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল ব্যাংক সেক্টরের নির্বাহীরা। নাসা দরবেশের পোদ্দারিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম কঠিন করে তুলেছিলেন ব্যাংক খাতের স্বঘোষিত পিতৃপুরুষ নজরুল ইসলাম মজুমদার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয় নজরুল ইসলাম মজুমদারের ক্ষমতার অপব্যবহার। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে তার মেয়াদকালে বহুবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তহবিলে অনুদান দিতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাংকাররা। ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) অধীনে নগদ অর্থ বা কম্বলের মতো অনুদান সংগ্রহ করতেও মজুমদার মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন।

সাধারণত সিএসআর তহবিলের অর্থ ব্যাংকগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং সামাজিক কল্যাণে বাস্তবায়িত প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বরাদ্দ রাখে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির জন্য ব্যাংকগুলোকে অনুদান দিতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আরও জানা গেছে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকান্ডেও সিএসআর তহবিলের অর্থ দিয়েছেন মজুমদার। ফলে খাতসংশ্লিষ্টরা তাকে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী বলে অভিহিত করেছেন।

তথ্যমতে, বিএবি দ্বিতীয়বারের মতো বিতর্কিত শেখ হাসিনা আন্তব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৪ আয়োজন করতে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। বহুল আলোচিত টুর্নামেন্টটি আয়োজনে-২০২৩ সালেও সিএসআর তহবিলের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যবহার করা হয়েছিল। এ ছাড়াও শেখ রাসেল জাতীয় শিশু ও কিশোর পরিষদ এবং শেখ কামাল যুব গেমসসহ বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্টের মতো কর্মসূচির নামে ব্যাংকগুলোকে ঘন ঘন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান দিতে বাধ্য করতেন মজুমদার। এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের দুজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী বলেছেন, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী মজুমদার শুধু ব্যাংকগুলোকে ফুটবল টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা করতে অনুদানের জন্য চাপ দেননি বরং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সব কর্মীর এক মাসের বেতন প্রদান করতেও বাধ্য করেছিল।

টুর্নামেন্ট সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য উৎসবে মিলিত হতে এমডি থেকে পিওন পর্যন্ত সবাইকে বেতন দিতে হয়েছে। এজন্য বিএবি প্রধান হিসেবে পরবর্তীতে এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোতে চিঠি দিতেন তিনি। জ্যেষ্ঠ ব্যাংকাররা আরও বলেন, বেশির ভাগ ব্যাংক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সিএসআর ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা মেনে চলতে পারেনি। কারণ তহবিলের সিংহভাগ অর্থ টুর্নামেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য কর্মকান্ডে দিতে হয়েছে। এ বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, অনুদান সীমিত হওয়া উচিত।

এটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক খাতের উন্নয়নের জন্য প্রদান করা হবে। আরেক জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মেহমুদ হোসেন এটাকে ‘অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে সিএসআর তহবিলের অর্থ ব্যবহারের এ ধরনের প্রক্রিয়া আরোপ করাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, এ ধরনের কর্মকান্ড দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করতে বাধা সৃষ্টি করেছে। ব্যাংক এশিয়া, এনআরবি ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক এই এমডি এবং সিইও আরও বলেছেন, অনুদানের বিষয়ে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নির্বাহীদেরও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল, বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আবাসন প্রকল্পগুলোতে অনুদান দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। দান হলো এক ধরনের দাতব্য, কিন্তু জোর করে বা চাপিয়ে দিলে এর প্রকৃত মূল্য হারিয়ে যায়, এই ব্যাংকার ব্যাখ্যা করেন।

এ ধরনের বাধ্যতামূলক সিএসআর ব্যয় ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস করে, যা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ আয়কে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার টেকসই অর্থ বিভাগের সঙ্গে সব তফসিলি ব্যাংক দ্বারা বাস্তবায়িত সামগ্রিক সিএসআর কর্মসূচির তত্ত্বাবধান করছে। আমরা সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টের সঙ্গে সংগতি রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। নজরুল ইসলাম মজুমদার ২০০৮ সাল থেকে বিএবির নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে ঋণ এবং আমানত উভয়ের ওপর সুদের হারের ওপর একটি ক্যাপ আরোপের একজন স্থপতিও ছিলেন তিনি। অর্থনীতিবিদদের মতে, গত কয়েক বছরে বাজারভিত্তিক সুদ ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সুদের হার নির্ধারণ করে দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর আগে ২০১৮ সালের ২০ জুন মজুমদারের নেতৃত্বে বিএবি প্রথমে ওই অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ঋণ এবং আমানত উভয়ের সুদের হার যথাক্রমে ৯ শতাংশ এবং ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।

তার আগে এপ্রিলে সোনারগাঁও হোটেলে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) এবং বিএবির ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজনের মাধ্যমে তিনি ব্যাংকগুলোর নগদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা (সিআরআর) ১ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে নজরুল ইসলাম মজুমদার ২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ২৬১ কোটি টাকার ঋণের সুদ মওকুফ করিয়েছেন বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। সরকারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৬৫৪তম সভায় নাসা গ্রুপের দুটি কোম্পানি নাসা তাইপেই স্পিনার্স এবং নাসা স্পিনার্সের সুদ মওকুফ অনুমোদন করেছে। এর আগে ২০০৮ সালে জনতা ব্যাংক নাসা গ্রুপের ওই দুই কোম্পানির ১২০ কোটি টাকার ঋণ অধিগ্রহণ করেছিল সাউথইস্ট ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে।

বোর্ড সভার কার্যবিবরণী অনুসারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি নাসা তাইপেইকে ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট ১৫৬ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করার শর্তে এই সুবিধা দিয়েছে। নিয়মবহির্ভূত সুবিধা দেওয়ায় ২০২১ সালের জুনে, ‘ব্যাংকিং নিয়মের লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক সুবিধাটি বাতিল করেছিল। রাজনৈতিক চাপে পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সুদ মওকুফ সুবিধা অনুমোদন করে। সার্বিক বিষয়ে নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।