• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

নাশকতার ব্লুপ্রিন্ট-নভেম্বর ছক বাস্তবায়নে ইব্রাহীম মোল্লাকে হত্যা করে শিবির গংরা


প্রকাশিত: ৩:৩৪ এএম, ২৪ অক্টোবর ১৫ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫০ বার

169539====================বিশেষ প্রতিবেদক:   যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাঁধাগ্রস্থ করার মহাপরিকল্পনা ও নাশকতার ব্লুপ্রিন্ট রক্ষিত ব্যাগ রক্ষায়  এএসআই ইব্রাহীম মোল্লাকে  হত্যা করে শিবির নেতা এনামুল ও তার সহযোগীরা। ব্যাগ তল্লাশি করলে আগেভাগে গুরুত্বপূর্ণ দলিল ভাঁস হয়ে যাবে এমন আশংকায় ঘাতকরা হত্যা করে ইব্রাহীম মোল্লাকে।

রাজধানী ঘিরে বড় ধরনের নাশকতার ছক কষছে জামায়াত-শিবির। এ লক্ষ্যে তারা অস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুদও করছে। তাদের এই নাশকতার পরিকল্পনার নাম ‘অপারেশন নভেম্বর’। বেকায়দায় ফেলা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করাই তাদের লক্ষ্য বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।

বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গাবতলীতে চেকপোস্টে তল্লাশির সময় এক ‘ব্যক্তির’ ছুরিকাঘাতে দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহীম মোল্লা নিহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মাসুদ রানা নামের এক যুবককে আটক করলেও ঘাতক পালিয়ে যায়। মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। সে বগুড়ার আদমদীঘি থানা শিবিরের সদস্য। পলাতক ঘাতকের নাম এনামুল হক। সে আদমদীঘি থানা শিবিরের সভাপতি। এনামুলের বিরুদ্ধে বগুড়ায় নাশকতার মামলা রয়েছে।

মাসুদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত কামরাঙ্গীরচর, গাজীপুর ও বগুড়ায় কয়েকটি এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ২৮ জনকে আটক করা হয়। কামরাঙ্গীরচরে শিবিরের একটি আস্তানা থেকে কামরাঙ্গীরচরের বাসা থেকে হ্যান্ড গ্রেনেডসদৃশ পাঁচটি পাইপ বোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। গাজীপুরে একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে নাশকতার ছকসংবলিত নথি পাওয়া গেছে।

গতকাল দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে এএসআই ইব্রাহীম মোল্লার জানাজা শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, দেশের স্বাধীনতা বিশ্বাস করে না এমন একটি সংগঠন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।

এ ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি-না জানতে চাইলে শহীদুল হক বলেন, ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার হওয়া মাসুদকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য এসেছে। তার পরও তারা বিষয়টি আরও তদন্ত করছেন।ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, মাসুদের তথ্য অনুযায়ী কামরাঙ্গীরচরে অভিযান চালিয়ে বিস্ফোরক ও তাজা বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।

পুলিশের মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন জানান, এএসআই ইব্রাহীমের খুনিকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এ ঘটনায় দারুস সালাম থানায় একটি মামলা হয়েছে। এই মামলায় এনামুল ও মাসুদসহ অজ্ঞাত ১০ জনকে আসামি করা হয়।বগুড়ার আদমদীঘি থানার ওসি শওকত আমির বলেন, এনামুল আদমদীঘি থানা শিবিরের সভাপতি। বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশ শুক্রবার রাতে বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে।

যেভাবে অভিযান :বৃহস্পতিবার রাতে ঘটনাস্থল থেকে মাসুদ রানাকে গ্রেফতারের পরই ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মাসুদের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের কয়েকটি টিম নাশকতার পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতারে মাঠে নামে। কামরাঙ্গীরচরে একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ।

সেখানে শিবিরের একটি মেস থেকে বিস্ফোরক ও তাজা বোমা উদ্ধার করা হয়। এর পরই মাসুদের কাছে তথ্য মেলে, গাজীপুরে তাদের একটি মেস রয়েছে। যেখানে তারা বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করত। পুলিশের একটি দল ওই মেস থেকে উদ্ধার করে নাশকতার পরিকল্পনাসংবলিত গুরুত্বপূর্ণ নথি। প্রাপ্য তথ্য যাচাই করে বগুড়ার কয়েকটি এলাকায় অভিযানে স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

২৮ জন আটক :মাসুদ রানার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ইউনুছ আলী, উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফি আহম্মেদ, বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মেহেদী হাসান ও সাবেক ইউপি সদস্য তফিকুর রহমানকে আটক করা হয়। বগুড়ার মসজিদ ছাত্রাবাস থেকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ২১ জনকে আটক করে শুক্রবার রাজধানীতে আনা হয়।

তারা হলেন_ কোরবান আলী, বিপুল মিয়া, সোহেল রানা, শফিকুল ইসলাম, ফরহাদ হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, রায়হান আলী, কাওসার, মেহেদি হাসান, মাসুদ রানা, সাজেদুর রহমান, সাদ্দাম হোসেন, রুহুল আমিন, রুমন মিয়া, মহসিন আলী, জুয়েল রানা, সিজু মিয়া, সুলতান মাহমুদ, কামরুজ্জামান, গোলাম মোস্তফা ও নাজমুল হক।

এ ছাড়া কামরাঙ্গীরচর থেকে আটক করা হয় আজিজ, রাব্বী ও রাকিবকে। বগুড়া সদর থানার ওসি আবুল বাশার বলেন, বগুড়া থেকে আটককৃতরা শিবিরের কর্মী। শুক্রবার রাতে তাদের ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে চেকপোস্টে সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করলেও এবারই প্রথম খুব কাছ থেকে ছুরিকাঘাত করে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করা হলো।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাসুদ জানিয়েছে, পলাতক এনামুলের ব্যাগে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। গ্রেফতার এড়াতে সে ব্যাগে থাকা ছুরি বের করে এক পুলিশকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। মাসুদের কাছ থেকে একটি ক্যামেরা পাওয়া গেছে। তবে তারা বগুড়া থেকে ঢাকায় এসেছিল কি-না, তা নিশ্চিত করা যায়নি। তাদের গন্তব্য কোথায় ছিল, সে ব্যাপারে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে মাসুদ।

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গাজীপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় নাশকতার বড় ছক। উদ্ধার করা নথিপত্র বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা জানতে পারেন, নভেম্বরে রাজধানীতে বড় নাশকতার ছক এঁকেছিল জামায়াত-শিবির। অপরিচিত কর্মীদের ঢাকার রাস্তাঘাট চেনাতে ম্যাপ ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল গাজীপুরের একটি বাসায়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, চক্রটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ এড়াতে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় তাদের আস্তানা গড়েছে। তারা গাজীপুরের বাসায় পরিকল্পনা করছিল; আবার কামরাঙ্গীরচরের একটি বাসায় বিস্ফোরক রেখেছে। পাঁচ-সাত দিন আগে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল শিবিরকর্মীরা। গ্রেফতারের পর মাসুদ রানা অন্তত আটটি ছদ্মনামের কথা জানায়।

পুলিশের গাফিলতি খতিয়ে দেখবে কমিটি :পুলিশ হত্যার ঘটনায় গতকাল ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) শেখ মারুফ হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্য সদস্যরা হলেন_ মিরপুর বিভাগের ডিসি কাইয়ুমুজ্জামান ও ডিবির ডিসি (পশ্চিম) সাজ্জাদুর রহমান। পুলিশ হত্যার ঘটনায় ডিএমপির তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় দায়িত্বরত অন্য সদস্যদের গাফিলতি ছিল কি-না, তাও খতিয়ে দেখবে কমিটি। এ ছাড়া কেন, কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তাও তদন্ত করা হবে।
স্বজনদের বক্তব্য :নিহত ইব্রাহীম মোল্লার স্ত্রী খায়রুন্নেছা জানান, তার স্বামীর ব্যক্তিগত কোনো শত্রু ছিল না। ২০০৩ সালে ইব্রাহীম কনস্টেবল পদে যোগ দেন। ২০১২ সালে এএসআই হিসেবে পদোন্নতি পান। এর আগে তিনি মিরপুরের ভাসানটেক থানায় কর্মরত ছিলেন। কয়েক মাস আগে দারুস সালাম থানায় বদলি হন। ইব্রাহীমের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের বয়স পাঁচ বছর ও ছেলে পরাগের বয়স মাত্র দেড় মাস। জানাজা শেষে ইব্রাহীমের মরদেহ পুলিশ পাহারায় বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার পালপাড়া গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়।

শোকের মাতম :বাগেরহাট থেকে জেলা প্রতিনিধি জানান, এএসআই ইব্রাহীম নিহত হওয়ার ঘটনায় তার নিজ এলাকা কচুয়া উপজেলার পালপাড়া গ্রামে চলছে শোকের মাতম। আবদুস সাত্তার মোল্লার পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলেসন্তানের মধ্যে ইব্রাহীম ছিলেন পঞ্চম। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে বাবা নির্বাক। ছেলের এমন মৃত্যুর খবরে মা আছিয়া বেগম ঘরে প্রলাপ করছেন। ভাই হারিয়ে বিলাপ করছিলেন বোনেরাও। ইব্রাহীমের মৃত্যুর খবরে গতকাল তাদের বাড়িতে শত শত লোক জড়ো হন। ইব্রাহীম দারুস সালাম থানার কাছেই ৪৮/৩ বর্ধবাড়ী এলাকার পঞ্চম তলায় দেড় বছর ধরে ভাড়া বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন।