নব্বই বছর বাঁচা হলোনা তাঁর-
বিশেষ প্রতিনিধি : নব্বই বছর পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানী। কিন্তু করোনা তাঁকে বাঁচতে দিল না। স্বজনরা জানান, বাংলাদেশ নিয়ে তার অনেক ভাবনা ছিল বলেই এমনটা চেয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন নিজের মরদেহটাও হাসপাতালে দিতে। কিন্তু করোনার কারণে তা হলোনা। তবে তাঁর ছেলে সাগর লোহানী জাতিরকন্ঠ কে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরবর্তীতে এ বিষয়টি নিয়ে তাঁরা পদক্ষেপ নেবেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ একাধিক বিশিষ্ঠ ব্যক্তি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। শনিবার (২০ জুন) সকাল ১০টার দিকে তিনি মারা যান। তার ছেলে সাগর লোহানী জাতিরকন্ঠ কে একথা জানিয়েছেন। এর আগে শুক্রবার (১৯ জুন) বিকাল ৫টার দিকে তাকে রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তিনি বলেন, ‘ভোর সাড়ে ৬টায় বাবাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সোয়া ১০টায় লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। বাবার মাল্টিপাল অরগান অফ হয়ে গিয়েছিল। প্রেসার কমে গিয়েছিল, একেবারেই বাড়েনি। কিনডি ইনঅ্যাকটিভ হয়ে গিয়েছিল।’ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরে তাকে সমাহিত করা হবে।ফুসফুস ও কিডনির জটিলতা নিয়ে রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন কামাল লোহানী। সেখান থেকেই তাকে কোভিড ডিডিকেটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শুক্রবার সাগর লোহানী বলেন, ‘বর্তমানে তিনি গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন। কিছু শারীরিক জটিলতার কারণে বুধবার বাবাকে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিনই তার করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা নেওয়া হয়। শুক্রবার পরীক্ষার রিপোর্টে পজিটিভ আসে। এরপর তাকে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে নিয়ে আসি।’তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে গত ৫ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরেন তার বাবা। এরপর করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে আর কোথাও চিকিৎসা করানো হয়নি। শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ১৭ মে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা নিয়ে ২ জুন বাসায়ও ফিরে যান। আবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ফের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
কামাল লোহানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী: কামাল লোহানী নামে পরিচিত থাকলেও তার আসল নাম আবু নাইম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার খান মনতলা গ্রামে তার জন্ম হয়। ১৯৫২ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। পরে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে।১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি পাবনা জেলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র। ওই আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই রাজনীতির হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নূরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাকে জেলেও যেতে হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার হন। সেই সময়ই তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন। পরের বছর আবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে বন্দি ছিলেন তিনি।
১৯৫৮ সালে যুক্ত হন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারও রাজনৈতিক সাংস্কৃতিককর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হন। পরে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’।ষাটের দশকের শেষ ভাগে ন্যাপের (ভাসানী) সঙ্গে যুক্ত হয়ে কামাল লোহানী যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী যুদ্ধে যোগ দেন। সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পান।কামাল লোহানীর সাংবাদিকতার শুরু হয়েছিল দৈনিক মিল্লাত দিয়ে। এরপর আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুই দফা যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী। ১৯৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নতুন করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুই দফায় মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী। পাঁচ বছর ছিলেন ছায়ানটের সম্পাদক। তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা পদেও ছিলেন।১৯৬০ সালে কামাল লোহানী বিয়ে করেন। স্ত্রী দীপ্তি লোহানী বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তাদের দুই মেয়ে এবং এক ছেলে।