নতুন বছরে চাই সোনার বাংলাদেশ
হাসান আজিজুল হক : নতুন বছরে চাই সোনার বাংলাদেশ । পুরাতন বছরের শেষ দিন থেকে নতুন বছরের প্রথম দিনে ‘নতুন বাংলাদেশ’ কি দেখতে পেয়েছি আমরা? না, তেমন কিছু হয়তো হবে না। কিন্তু আমরা প্রত্যাশা নিয়ে থাকব।
আমাদের এখন কেতা বদলেছে। আগেকার কেতায় আমরা বর্ষ শুরু বলতে পহেলা বৈশাখকেই বুঝতাম। নতুন কেতায় আমরা এখন পহেলা জানুয়ারি পালন করতে শুরু করেছি। ‘সাল’ কারও নিজের কেনা নয়, তেমনি সময়ও কারও নিজের কেনা নয়। সময় বলে কিছু আছে বলেও জানা যায় না।
আমরা বলছি, আমাদের সামনের জগৎ পরিবর্তন হচ্ছে এবং পরিবর্তনহীন একটা সময়ও আমরা পাই না। এই মুহূর্তগুলো এমন, একমুহূর্ত থেকে অন্য মুহূর্তের মধ্যে কোনো ফাঁকও নেই। সময় প্রবহমান, সময়কে বিন্দুতে বিন্দুতে যে ভাগ করে নেব, তারও উপায় নেই। তবুও আমরা নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য কতটা সময় গেল, সেটা বোঝার জন্য সময়কে ভাগ করে নিচ্ছি। সময় বলে আসছে কিছু নেই। বছরের হিসাবটাও তাই।
সময়ের স্রোত অবিরাম বয়ে যাচ্ছে। হেরাক্লেটাস বলেছেন, ‘ We could not step twice into the same river’, অর্থাৎ একই নদীতে আমরা দু’বার স্নান করতে পারি না। দার্শনিকগণ এমন অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ অত কথা বুঝি না, ফলে আমরা সময়কে ভাগ করে নিই। আমরা সময়কে মুহূর্তে ভাগ করি, দিনে ভাগ করি, ঘণ্টায় ভাগ করি, মিনিটে ভাগ করি, সেকেন্ডে ভাগ করি- এভাবে নানাভাগে ভাগ করি।
ফলে নতুন বছরে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। গত দিনটিতে যা হয়েছে, আজকের দিনে তার থেকে খুব আলাদা কিছু হবে বলে মনে হয় না। আবার আমাদের সময় যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন আমরা সবাই মাটির নিচে চলে যাব। সে জন্য সময় নিয়ে হাহাকার করারও কিছু নেই, সময় নিয়ে উল্লাস করারও কিছু নেই। কিন্তু আমাদের মানুষের স্বভাব হেেচ্ছ, আমরা সময়কে মাপি এবং বলি- Time and tide wait for none, সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না।
খ্রিস্টান পঞ্জিকামতে, আজ পহেলা জানুয়ারি, বছরের প্রথম দিন। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এই দিনটিকে উদযাপন করে। যতদূর পারা যায়, তারা এই দিনকে উপভোগ করে। আর স্মৃতিচারণ করতে থাকে। যে বর্ষ চলে গেল, সেই বর্ষের কথা ভাবে আর নতুন বছরের শুভেচ্ছা পরস্পরকে বিনিময় করে।
আমাদের নববর্ষ পহেলা বৈশাখেও অনুষ্ঠান হতো। হালখাতা অনুষ্ঠান। বারো মাসে তেরো পার্বণ হতো এখানে। এগুলো এখন আর হয় না। এটা নাগরিকতার প্রভাবে হয় না, বোঝাও যায় না। সে জন্য পহেলা বৈশাখও বোঝা যায় না, পহেলা জানুয়ারিও বোঝা যায় না।
আজ দেশের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা ‘আজ নতুন বছরের প্রথম দিবস’ বা ‘স্বাগতম ২০১৭’ এমন হেড লাইন করেছে। এবং অনেকে অনেক কথা বলবে, কেউ সালতামামি করবে, গত এক বছর কেমন করে কাটিয়েছি, সে অনুযায়ী সামনের এক বছর কেমন করে কাটাব- এমন নানা হিসাব-নিকাশ হবে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা এতটাই মন্থর যে তাদের অবস্থা খুব বেশি পাল্টাবে, এমনটা বলা যায় না। তাদের অবস্থা এমন যেন কাচের মূর্তি, নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
নতুন বছরের আনন্দ-উদযাপন ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকা শহরকে যদি আমি মোটরের হেডলাইট বলি, তাতে ভুল বলা হবে না। হেডলাইটের দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আর তার সামনের দিকেই শুধু আলো বাকি দুই পাশ নিকষ কালো অন্ধকার। এমন কথায় লোকে আমাকে বলবে, এই মানুষটা এত বেশি রকমের নিরাশাবাদী!
আমি নিরাশাবাদী নই, আমি পরিবর্তনবাদী। পরিবর্তন কিন্তু হচ্ছে, পরিবর্তন হয়েছে এবং হবে। কোনোটা ভালো পরিবর্তন, কোনোটা বাজে পরিবর্তন। নতুন বছরে কীভাবে বলব, আমাদের এখানে মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হবে; এখন পর্যন্ত এটা তো সুদূরপরাহতই বটে।
আমাদের পরবর্তী যে প্রজন্ম, তারা তাকিয়ে থাকবে আমাদের দিকে, তারাও তো হিসাব করবে একটা সময়। তাদের জন্যও তো কিছু দেখছি না। টাঁকশাল থেকে যেমন নতুন মুদ্রা বেরিয়ে আসে, তেমনি পুরাতন বছরের শেষ দিন থেকে নতুন বছরের প্রথম দিনে ‘নতুন বাংলাদেশ’ কি দেখতে পেয়েছি আমরা? না, তেমন কিছু হয়তো হবে না। কিন্তু আমরা প্রত্যাশা নিয়ে থাকব।
নতুন বছরের আনন্দ উদযাপনে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, এই আশা তো থাকবেই। আশা থাকবে, নতুন বছরে যেন উগ্রবাদীদের উত্থান আর না ঘটে। আমরা সাধারণ মানুষও সচেতন রয়েছি, যারা ক্ষমতার দায়িত্বে আছে, তারাও সতর্ক, দেশে যেন আর কোনো উগ্রচণ্ডাল ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।
নারী নির্যাতন যেন আগের মতো না ঘটে। গ্রামে গ্রামে নারীদের ওপর নির্যাতন চলবে আর আমরা দেখাব- আমাদের নারীরা কেউ কেউ হিমালয় জয় করছে, কেউ কেউ বিশ্বজয় করছে। যে পিঠে আলো, সেটাই আমরা সব সময় দেখাই; যে পিঠে আলো কম, সে পিঠ আমরা দেখাই না।
আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে। আমরা যা করেছি এবং যা করতে পারি নাই, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। যা করতে পারি নাই, সেটা করতে পারা আমাদের দরকার ছিল; কিন্তু পারি নাই যখন, তখন এই অক্ষমতা স্বীকার করতে হবে। এবং জানাতে হবে, যা আমরা পারি নাই সেটা কাটিয়ে নতুন করে শুরু করব আগামী দিনে।
আমাদের লক্ষ্যে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞচিত্তে এগিয়ে যাব, রাষ্ট্রযজ্ঞের প্রতি এই থাকবে আমার আহ্বান। নিশ্চিন্ত, নির্বিঘ্ন, দারিদ্র্যপীড়িত নয় এমন একটা বছর দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কামনা করছি।