ধরা খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের চোরচক্র ফেডারেল রিজার্ভের অনুমতি ছাড়াই অর্থ ছাড়
বিশেষ প্রতিবেদক : ধরা খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের চোরচক্র।এরা ফেডারেল রিজার্ভের অনুমতি ছাড়াই অর্থ ছাড় করেছিল। সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে আসছে এই রাঘববোয়ালরা।বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮/৯ কর্মকর্তা রিজার্ভ চুরিতে সহায়তা করেছে। এই চক্রটি হ্যাকারদের সহযোগীতা করতে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অনুমতির আগেই অর্থ স্থানান্তর করে। কেন যাচাই করার আগেই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অর্থ ছাড় করেছে—তা জানতে চেয়েছে সিআইডি।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাত-আটজন কর্মকর্তাকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এসব কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব, মেইল আদান-প্রদান ও মোবাইল ফোনের কথোপকথনের তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদও করেছে সিআইডি।
তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা অবশ্য এখনই কারও নাম জানাতে রাজি হননি। এমনকি তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা—সে ইঙ্গিতও দিতে চায় না সিআইডি।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম বলেন, ‘সন্দেহভাজনের তালিকা আমরা ছোট করে এনেছি। যেসব নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে, তাঁদের দায়িত্বে চরম অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তাঁদের সঙ্গে হ্যাকারদের কোনো যোগসাজশ আছে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি।’
রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। সিআইডি সূত্র জানায়, তদন্তের অংশ হিসেবে সিআইডির দুটি দল এখন বিদেশে অবস্থান করছে। একটি দল ফিলিপাইন, অন্যটি শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করছে। এ ছাড়া ইন্টারপোলের একটি দলও সার্বক্ষণিক সহায়তা করছে সিআইডিকে। ঢাকায় তদন্ত সমন্বয়ের কাজ করছেন অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর বিভিন্ন সময়ে একাধিক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক কম্পিউটার জব্দ করেছে সিআইডি। অনেক কম্পিউটার জব্দ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ থেকেও।
এসব কম্পিউটার ও অন্যান্য ই-মেইল পরীক্ষা করে সিআইডি দেখেছে, হ্যাকিংয়ের সঙ্গে চীন, হংকং, জাপান, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের নাগরিকেরা জড়িত। এসব নাগরিকের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তথ্য পাঠানো হয়েছে। ইন্টারপোলের অর্থ পাচার শাখা এ তদন্তের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলে ঢাকায় ইন্টারপোলের শাখা (এনসিবি) কার্যালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সংযুক্ত কম্পিউটারে ম্যালওয়ার প্রবেশ করিয়ে পুরো ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছিল। এসব কম্পিউটার থেকে পরিশোধ আদেশ (পেমেন্ট অর্ডার) দিয়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অর্থ চুরি করা হয়। এর মধ্যে একটি কম্পিউটার থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ও পরবর্তী সময়ে মিসরে তথ্য পাঠানোর চেষ্টা করা হয়।
মিসরের সঙ্গে ইতিমধ্যে যোগাযোগ করে দেশটির কম্পিউটারের আইপি ঠিকানা ও প্রাপকের তথ্য চাওয়া হয়েছে সিআইডির পক্ষ থেকে। তবে গতকাল পর্যন্ত কোনো ধরনের তথ্য মেলেনি বলে জানা গেছে। আরও কোনো দেশ থেকে এসব আদেশ এসেছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখছে সিআইডি। সিআইডির ধারণা, একসঙ্গে একাধিক দেশ থেকে পরিশোধ আদেশ পাঠানো হয়েছিল।
সিআইডি সূত্র জানায়, হ্যাকারদের প্রথম পরিশোধ আদেশ নিয়েই সন্দেহ করে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। তারা ওই আদেশের সত্যতা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য চায় তখন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তথ্য পাওয়ার আগেই তারা অর্থ স্থানান্তর করে ফেলে। কেন যাচাই করার আগেই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অর্থ ছাড় করেছে—তা জানতে চেয়েছে সিআইডি।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেই এসব বিষয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কোনো তথ্য দেয়নি। আর এফবিআই এ ঘটনা তদন্ত করছে বলে এড়িয়ে গেছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকও।
এফবিআই সিআইডিকে জানিয়েছে, এ প্রশ্নের জবাব তারাও পায়নি।
এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে গত ১৫ মার্চ গঠিত তিন সদস্যের কমিটির তদন্তকাজও চলছে। গতকাল অগ্রগতি জানতে চাইলে ফরাসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, যথাসময়ে তিনি প্রতিবেদন দেবেন এবং তদন্তের স্বার্থে তার আগে কোনো মন্তব্য করতে চাইছেন না।
ফরাসউদ্দিন কমিটির কর্মপরিধিতে এক মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন এবং ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির কার্যপরিধি হচ্ছে—বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে এই অর্থ কীভাবে ও কার বরাবর গেল, অবৈধ পরিশোধ ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়েছে, বিষয়টি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন রাখার যৌক্তিকতা কী, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি না, অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা কতটুকু এবং একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে করণীয় কী ইত্যাদি।
রিজার্ভ চুরি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেনসিক দলও করছে আলাদা তদন্ত। এই দল বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কম্পিউটার পরীক্ষা করছে। পাশাপাশি নিরাপত্তা সফটওয়্যার স্থাপনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়। পুরো এপ্রিল মাস কাজ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে দলটি প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখনো বলার মতো কোনো পর্যায় আসেনি। তবে ফরেনসিক তদন্তের অগ্রগতি সন্তোষজনক।
টাকা ফেরতের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী—জানতে চাইলে শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘গণমাধ্যমের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি, কিছু টাকা ফেরত এসেছে। খুবই আশা করছি যে চুরি যাওয়া পুরো টাকাই ফেরত পাওয়া যাবে।’
গত ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ চুরি যায়। এ নিয়ে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ফিলিপাইনের ইনকোয়ারার নামক পত্রিকায়। পরে বাংলাদেশেও এ ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ঘটনার সূত্র ধরে এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান গত ১৫ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।