ধপাস মন্ত্রীদের আমলনামা-
বাদ পড়া মন্ত্রীদের মধ্যে আমলনামা এত খারাপ ছিল যে তিনজন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন এবং দলীয় সরকার তিন মন্ত্রীকে দলীয় মনোনয়নই দেয়নি।
শফিক রহমান : সরকারের বিদায়ী মন্ত্রিসভার ৩০ জন সদস্য জায়গা পাননি নতুন মন্ত্রিসভায়।এসব মন্ত্রীর আমলনামায় নানা বিতর্কসহ ব্লার্ক মার্ক ছিল। গোয়েন্দা ইনফরমেশনে তাদের বিরুদ্ধে ইঠে এসেছে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডসহ এন্তার অভিযোগ।
ফলে অনেকটা ধপাস করে এদের ছেঁটে ফেলে সরকার নিজেকে রক্ষা করেছে। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় এরা দেশের স্বার্থ না দেখে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করে নিজেরা এবং আলে-আওলাদসহ লাভবান হয়েছেন। জনস্বার্থ ভূলুন্ঠিত হয়েছে এসব মন্ত্রীর কারণে।
অনেকে এমন সব বিতর্কিত কথা বলেছেন যা নিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। ভোটের সময় এক মন্ত্রী তো বিএনপির আন্দোলন নিয়ে অতিকথন করে সরকারকে বিতর্কিত করে ছাড়েন। যার প্রেক্ষাপটে দলের সাধারন সম্পাদককে বলতে বাধ্য হতে হয় ওটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। দীর্ঘদিন ধরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে সরকারকে বিতর্কিত করে জনসাধারনের নাভিশ্বাস তোলেন বানিজ্য মন্ত্রী।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকিং সেক্টরে নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, হা-হুতাশ বাড়ানো, ডলার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং সর্বপরি ঋনখেলাপি নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থ হয়েছেন মন্ত্রী।
যে কারণে নতুন মন্ত্রিসভায় সরকার এনাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। সব চেয়ে বড় চমক হিসেবে দেখা গেছে বাদ পড়াদের দীর্ঘ তালিকা। বিদায়ী মন্ত্রিসভার ৩০ জন সদস্য জায়গা পাননি নতুন মন্ত্রিসভায়। এদের মধ্যে গত রোববারের ভোটের আগেই বাদ পড়েন দুজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী।বাদ পড়া মন্ত্রীদের মধ্যে আমলনামা এত খারাপ ছিল যে তিনজন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন এবং দলীয় সরকার তিন মন্ত্রীকে দলীয় মনোনয়নই দেয়নি।
তবে বাদ পড়া একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নতুন মন্ত্রিসভায় ফিরেছেন। তিনজন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, তিনজন দলীয় মনোনয়নই পাননি।অর্থ, বাণিজ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের চারজন মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর কেউই নতুন মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। বাদ পড়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। বাদের তালিকায় আছেন স্বাস্থ্য, কৃষি, ভূমি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীও। গত বছর জুড়েই আলোচনায় ছিলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন সংস্থার অভিযান ও উদ্যোগেও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম।এদিকে আর্থিক খাতও ছিলো আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে। এই খাতের বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় এসেছে বারবার।
ভোটের আগে আওয়ামী লগের নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সেসবের মধ্যে অন্যতম ছিলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো। এই দুই খাতে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট পুরোনো সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে নতুন তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে।বাদ পড়াদের মধ্যে রয়েছেন- অর্থমন্ত্রী আ হম মুস্তফা কামাল-যিনি ব্যাংকিং সেক্টরে নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, হা-হুতাশ বাড়ানো, ডলার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং সর্বপরি ঋনখেলাপি নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থ হয়েছেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান দেশ গঠনে সঠিক পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হন।এছাড়াও মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক পরিকল্পনা দেননি। একই অবস্থায় আর টেকনোক্র্যাট কোটার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম ভোটের আগেই পদত্যাগ করেছেন।পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা ছিলো বছর জুড়েই। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয় নিয়ে আলোচনা গড়িয়েছে একেবারে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমকে বাদ দেওয়া হয়েছে কূটচালে পারদর্শী না হয়ে অতিকথনে জড়িয়ে পড়ায়।
২০১৪ সাল থেকে পাঁচ বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো পেশাদার কূটনীতিক এএইচ মাহমুদ আলীকে আবার অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে নতুন মন্ত্রিসভায়। তবে তাকে কোন দায়িত্ব দেয়া হবে এবং তার সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী কেউ থাকবেন কিনা তা এখনো পরিষ্কার না।
মন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরই বিশ্বব্যাপি মহামারির ধাক্কা এসে পড়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সামনে। তবে সেই ধাক্কা সামলাতে গিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দেন তিনি। তারপরও বাংলাদেশ মহামারির ধকল কাটিয়ে ওঠে।তবে নানা সময় বেফাঁস মন্তব্য ও কথাবার্তা বলে আলোচনায় জড়িয়ে পড়া জাহিদ মালেক নতুন মন্ত্রিসভায় ঢুকতে পারেননি।
বিভিন্ন আলোচনার জন্ম দেওয়া এবং ভূমি অপরাধ আইনে জেলা প্রশাসকদের ব্যবস্থা নিতে সঠিক নির্দেশনা না রাখা, আইনে অনেক ফাঁকফোকর রেখে দেয়ায় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে নতুন তালিকা থেকে।
এর আগে মতিয়া চৌধুরী কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছিলো। তখন খাদ্য রপ্তানির কথাও আলোচনায় ছিলো। হঠাৎ করেই যেন পরিস্থিতি উল্টে যায়। পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে যায়। আবার আমদানির ক্ষেত্রে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাটানি চোখে পড়ে।
খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও ভোগের সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে বলে একাধিকবার অভিযোগ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।মূলত সিন্ডিকেট ভাঙ্গার ব্যর্থতায় উইকেট গেছে টিপুর।
তিনবার কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো মতিয়া চৌধুরীর পর ২০১৯ সালে কৃষিমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনিও কৃষিপণ্যর বাজার নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ হন। তাছাড়া নির্বাচনের সময় বিএনপিকে নিয়ে অতিকথন ও চ্যানেলে বিতর্কিত কথা বলায় নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তাকে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। তার নিজের ছেলে ও স্বজনদের বিরুদ্ধে বনের জায়গা দখলের অভিযোগ উঠেছে। জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরও নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে ঠিকাদারি কাজ নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন মন্ত্রিসভায় জায়গা হারিয়েছেন তিনি।
আলোচিত মন্ত্রীদের মধ্যে আরো বাদ পড়েছেন: রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন-যিনি রেলে নিরাপত্তা-নাশকতা সামলাতে পারেননি। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর উইকেট গেছে গাজীনগরের কারণে। এছাড়াও বিবিধ ধরনের বিতর্ক ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এর বিরুদ্ধে।
ব্যক্তিস্বার্থে দেশের স্বার্থ বজায় না রাখা, নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়া, অতিকথন, এলাকার দলের নেতৃত্ব বজায় রাখতে না পারা, দখলবাজি, ব্যক্তি স্বার্থের ওপরে উঠতে না পারায় প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে বাদ পড়েছেন: শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা।