ধনির দুলাল তাওসিফ জঙ্গি হলো কেন ?
এস রহমান : নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি তাওসিফ ছিল ধনির দুলাল। সোনার চামচ মুখে নিয়েই যেন ওর জন্ম। তারপরও তাওসিফ এর জঙ্গি হয়ে ওটা কেন-এনিয়ে চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। সরেজমিনে তাওসিফের ধানমণ্ডির ১৫ নম্বর সড়কের ১৯/২ নম্বরের বাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ৬ মাস ধরে নিখোঁজ ছিল তাওসিফ। ও মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। ছুটিতে মাঝে মাঝে সে দেশে আসতো।
এবছর এমনই এক ছুটিতে দেশে ফিরে ৩ ফেব্রুয়ারি নাস্তা করার কথা বলে সে ধানমণ্ডির বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর থেকেই সে নিখোঁজ ছিল। তাদের বাড়ির কেয়ারটেকার, নিরাপত্তাকর্মী ও বাসার গৃহপরিচারিকার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। কেয়ারটেকার মো. শহীদ জাতিরকন্ঠকে বলেন, ‘ওইদিন বিকালে তাওসিফ বাসা থেকে নাস্তা করার কথা বলে বের হয়। সন্ধ্যা পর হলেও সে ফিরে না আসায় তার বাবা আজমল সাহেব ইন্টারকমে ফোন দিয়ে গার্ড নান্নু মিয়ার সঙ্গে কথা বলেন।’
ধানমণ্ডির ১৫ নম্বর সড়কের ১৯/২ নম্বরের বাসাটিতে গত ৬ বছর ধরে কাজ করেন গার্ড নান্নু মিয়া । তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ। তিনি জানান, ‘এ বাসার চারতলার একটি ফ্ল্যাটে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতো তাওসিফ। তবে সে পড়তো মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে। সে কারণে তাওসিফ মালয়েশিয়াতেই থাকতো বেশিরভাগ সময়। তবে ছুটিতে দেশে এলে এ বাসাটিতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে উঠতো।’
গার্ড নান্নু মিয়া বলেন, ‘‘তাওসিফ ৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে বাসা থেকে কালো রঙের একটা ব্যাগ নিয়ে বের হয়। ব্যাগটির ওজন তেমন বেশি ছিল না। প্রতিদিন বিকালে সে বাসা থেকে বের হতো। আমি ভাবছি কোচিংয়ে যায়। সন্ধ্যায় আজমল স্যার ইন্টারকমে ফোন দেয়। আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘নান্নু মিয়া, আমার ছেলেটাকে যেতে দেখছো?’ আমি বললাম ‘হ স্যার।’ এরপর স্যার বলল, ‘এখনও তো বাসায় ফেরেনি।’ ওইদিনের পর থেকে তাওসিফকে আর এ বাসায় দেখা যায়নি।’’ ( কোচিং কেন করবে যদি ভার্সিটি স্টুডেন্ট হয়?)
এদিকে নারায়ণগঞ্জ জঙ্গি আস্তানায় তাওসিফ নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রাতেই তাওসিফের বাবা ডা. আজমল হোসেন ও মা ফরিদা হোসেন বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন, তা বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী, কেয়ারটেকার ও গৃহপরিচারিকাদের কেউ বলতে পারেন না।ওই বাসায় ছুটা কাজ করেন গৃহপরিচারিকা শাহানাজ বেগম। প্রতিদিনের মতো রবিবার সকালেও কাজ করতে এসে বাসায় এসে গার্ডদের কাছে শোনেন তাওসিফের বাবা মা কেউ বাসায় নেই। তিনি বাড়িটির নিচতলায় গার্ডদের কক্ষে বসে কথা বলতেছিলেন।
শাহানাজ বেগম বলেন, ‘আমি গতকাল কাজ করে বিকালে এই বাসা থেকে চলে গেছি। তখন স্যার ম্যাডাম বাসায় ছিল। কিন্তু এখন এসে শুনছি তারা কেউ বাসায় নেই। তালা দিয়ে গতকাল রাতেই চলে গেছে।’তিনি আরও বলেন, ‘তাওসিফ মালয়শিয়ায় পড়ে। দেখতাম বাসায় আসলে নামাজ পড়ে। হঠাৎ একদিন শুনি সে নাই। আমি গত ছয় বছর ধরে কাজ করি। খারাপ কিছু দেখিনি। কোনও বন্ধুবান্ধবও আসত না। সে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ত।’
শাহানাজ বেগম বলেন, ‘ম্যাডাম সারাদিন কান্নাকাটি করত। তার ভাইবোনদের বাসা থেকে খাবার দাবার দেওয়া হতো। তা খেত তারা। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে তাওসিফ সবার ছোট। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের জামাই মেজর। তারা ক্যান্টনমেন্ট থাকে। ছোট মেয়ে কানাডাতে পড়ালেখা করেন। তাওসিফ মালয়শিয়া পড়ত।
কেয়ারটেকার শহীদ বলেন, ‘ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে তারা চলে গেছে। আমাদের বাসায় খেয়াল রাখতে বলছে।’
তিনি বলেন, ‘তাওসিফ শুক্রাবাদের একটি মসজিদে নামাজ পড়ত। নামাজ পড়ে আবার চলে আসত। এমন হলো কেন বুঝতে পারতেছি না।তিনি আরও বলেন, ‘যাওয়ার সময় তার ব্যাগটি খুব হালকা দেখা গেছে। মোবাইলও নেয়নি।
র্যাব থেকে সর্বশেষ প্রকাশিত নিখোঁজের তালিকার সাত নম্বরে রয়েছে তাওসিফ। তাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহী।তাওসিফ নিখোঁজ হওয়ার পর তার বাবা ধানমণ্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিল।
রবিবার ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের (সিটি) সূত্র নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি হামলায় নিহত তামিমের অপর দুই সহযোগীর পরিচয় নিশ্চিত করে। এরমধ্যে একজনের নাম ফজলে রাব্বী, বাড়ি যশোর। অপর জঙ্গির নাম তাওসিফ হোসেন। সে ঢাকার ধানমণ্ডির ১৫ নম্বর (নতুন) সড়কের বাসিন্দা। তার বাবার নাম ডা. আজমল হোসেন।
র্যাবের দেওয়া সর্বশেষ নিখোঁজ তালিকায় তাওসিফের নাম ৭ নম্বরে ছিল। সে গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ হয়। এ বিষয়ে ধানমন্ডি থানায় ওই দিনই একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১৪৩) দায়ের করা হয়েছিল। ম্যাপেল লিফ নামে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করা তাওসিফ মালোশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, তাওসিফের বিষয়ে আমরা ৯৫ ভাগ নিশ্চিত হয়েছি। বাকি ৫ ভাগ রবিবার ‘রিচেক’ করার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ধানমণ্ডি থানার ওসি মো. আব্দুল লতিফ জাতিরকন্ঠকে জানান, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। তার (তাওসিফের) নাম শুনেছি। জিডি হয়েছিল। তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছি।’উল্লেখ্য, গত শনিবার নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার একটি বাসায় গোপন খবরের ভিত্তিতে অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটি) ও পুলিশের এলআইসি শাখা।
ওই অভিযানে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীসহ তিন জঙ্গি নিহত হয়।প্রথমে অপর দুজনকে ইকবাল ও ভাবলেও আজ রবিবার তাদের একজন যশোরের ফজলে রাব্বী ও অপরজন রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার তাওসিফ হোসেন বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ।